আমরা কবিতা পথের যাত্রী ।। তাজ ইসলাম


 আমরা কবিতা পথের যাত্রী
তাজ ইসলাম 

তার সময়ের অনেকের বই বাজারে এসেছে। তার আসেনি। বই প্রকাশ না হলেও বাক্সবন্দি আছে অনেক বই। বাক্সবন্দি বইগুলো এখনো বই হয়ে প্রকাশ হয়নি। তাই তারা এখনো ঘুমায় পাণ্ডুলিপি নামে। আমরা তাকে পাণ্ডুলিপি দিতে বলেছি ও বলছি। একটু উদাসীনতা আছে তার নিজের বই প্রকাশের প্রতি। উদাসীনতা কাটিয়ে রেদওয়ানুল হকের বই হওয়া উচিত।

রেদওয়ানুল হক রেদুমিক খ্যাত কবি। রেদওয়ানুল হক তুখোর ছড়াকার, ধ্যানী কবি, দক্ষ সম্পাদক। সম্পাদনায় মজে কবিতা চর্চায় তার ছেদ ঘটেছে। পাঠক বঞ্চিত হয়েছে তার কবিতার রসাস্বাদন থেকে। রেদুমিক চর্চা আছে অব্যহত এবং নিবেদিত। রেদুমিকের শুরুটা প্রায় বিশ বছর আগে। নিব নামে একটি ছড়াম্যাগে নিয়মিত প্রকাশ হতো। সে সময় এক আড্ডায় তার এই ফর্মটা নিয়ে আমি বলেছিলাম পরিকল্পিত ও নিয়মিত করতে। রেদওয়ান করেছে এবং আজকে রেদুমিক প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় হয়ে মন জয় করেছে পাঠকের।

রেদুমিকই রেদওয়ানের সাহিত্য চর্চার এই সময়ে প্রধান ও সহজ মাধ্যম। ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ শতাধিক রেদুমিক লিখেছেন। রেদুমিকের মূল আকর্ষণ হল নিজের বক্তব্য ছয় পঙক্তিতে প্রকাশ করেন। অল্প কথায় বিস্তর বলেন। ক্ষুরধার বক্তব্য ছন্দোবদ্ধভাবে পেশ করেন। দুইটা রেদুমিক এই ফাঁকে পাঠ হতে পারে।

রেদুমিক-৫৬৯
আরো কিছু মেহনত করার বাকি।
আরো কিছু কষ্ট, 
তারপর পষ্ট! 
জানি জানি সূর্যটা উঠবে ডাকি।
আরো কিছু মেহনত করার বাকি
জান আর মান দিয়ে লড়ার বাকি।

রেদুমিক-৫৮০
আবেগের সাথে বিবেকের যদি বেধে যায় টক্কর
বন্ধু তোমার পদে পদে কাঁটা
যাবে না আর খুশিমনে হাঁটা
মাথাটা ভীষণ ঝিম ঝিম হবে, খাবে শুধু চক্কর।
আবেগের সাথে বিবেকের যদি বেধে যায় টক্কর
হবে না হবে না স্বপ্ন পূরণ- যতো বলি ঢক কর।

সম্পাদক হিসেবেও তিনি দক্ষ ও জনপ্রিয়। লেখকদের প্রিয়ভাজন ও আস্থাভাজন সম্পাদক রেদওয়ানুল হক। ব্যক্তি রেদওয়ান বন্ধু বন্ধুবাৎসল, মৃদুভাষী, বিনয়ী মানুষ। রেদওয়ান শব্দধ্যানী কবিতা সাধক। তিনি কবিতা লেখেন বিষয়ের গভীরে প্রবেশের পর, বিষয়কে গভীর পাঠের পর। বিষয়কে পাঠ করেন। তারপর তার মর্মে পৌছেন। অতঃপর শব্দে শব্দে তার বয়ান দেন নিজের পাঠকের সামনে। রেদওয়ানের কবিতায় থাকে চিন্তার গভীরতা, দর্শনের উপাত্ত। কবির একটি কবিতা আমরা পাঠ করি।

‘ভিতরে না ঢুকলে কিছুই বোঝা যায় না,
চেনা যায় না কে কতোটা নির্মম!
কার হৃদয় উপচে পড়ে দয়ার সমুদ্র,
কারটা বিক্রি হয়ে গেছে নির্বেবেক পতিতালয়!
কে কতো বড় লুচ্চা, চোর, বদমাশ!
কার আস্তিনের ভিতর লুক্কায়িত বিষমাখা ছুরি,
কে হিরণ, কে মীরণ- কিছুই বোঝা যায় না।
জানা যায় না অহংকারের কতো বেয়াদব রঙ!
কোন চোখে সীমাহীন আলো-তেজপাতা বাতাস
কে অতি দয়াপরবশ রসুলের মতো
কে অন্ধ ফকির, ভিখারীর চেয়েও ভিখারী!
কারুন, ফেরাউন, নমরুদ-
ভিতরে না ঢুকলে কিছুই বোঝা যায় না।
কে শাসক-প্রশাসক, কে শোষক?
মানবতার পুরো উল্টো পীঠ
কোন ফুলে ঘ্রাণ আছে-কোনটায় নেই
কে সিংহশাবক আর কে ছাগলের বাচ্চা?
স্পষ্ট হয় না ভিতরে না গেলে!
একটি বনে কতো ঝোঁপঝাড় থাকে- জঙ্গল থাকে
সাপ-বিচ্ছু আরো কতো কী থাকে!
ভিতরে না ঢুকলে কিছুই বোঝা যায় না,
জানা যায় না নদীর ভিতরে কতো নদী প্রবহমান। (ভিতরবাহির)’

তার কবিতা উপলব্ধি করতে হলে পাঠ করতঃ ভিতরে প্রবেশ করতে হবে আবশ্যিকভাবে। রেদওয়ানের কবিতায় থাকে উপমা উৎপ্রেক্ষার মণিমুক্তা। কবিতা নাড়া দেয় বোধ ও চিন্তার জগতকে। তুচ্ছ বিষয়কে কবিতায় গন্থিত করেন দক্ষ চারু ও কারুশিল্পীর মতো। শব্দ তার তুলি,শব্দ তার সুঁই। তখন তন্ময় হয়ে পাঠ করা ছাড়া উপায় থাকে না। 

‘ছেঁড়া স্যান্ডেলটি পুরাপুরি ছিঁড়ে যাবার আগেই
সেলাই করে নাও, নয় তো বাকিপথ হেঁটে যেতে
হতে পারে খালিপায়,
পাড়াতে হতে পারে রাস্তার দুর্গন্ধ ময়লা, কিংবা-
বিঁধে যেতে পারে অসতর্ক লোহার পেরেক।
সাবধান হও এখুনি!
এবং ঠিক করে নাও টর্চের ঘুমন্ত আলো।
সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।
সাপের হিস হিস, চামচিকা-বাদুড়
গায়ে হামলে পড়তে পারে যে কোনো মুহূর্তে।
বুকের যে অংশ ছিঁড়ে গেছে ভালোবাসতে বাসতে,
সে অংশও জোড়া লাগাও পরম ধৈর্যে।
নয়তো ফিকে হয়ে যেতে পারে জীবনের সমস্তটা,
খসে যেতে পারে নক্ষত্রের রুপালি প্রভাত।
ছেঁড়া ঘর, ছেঁড়া ছাতা মেরামত করো তাড়াতাড়ি,
নয় তো পুরোদমে ভিজতে হবে আগামী বর্ষায়। (জরুরি এলান)’ 

রেদওয়ানুল হকের জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১। বসবাস ঢাকা মিরপুরে। ৫ ভাই বোনের মাঝে তৃতীয়। আধুনিক ধীমান এই কবির মলাটবদ্ধ বই পাঠকের কাছে হাজির হওয়া সময়ের দাবী। আমরা জানি তার বিচিত্র কিসিমের পাণ্ডুলিপি প্রস্তত আছে। লেখক গা ঝাড়া দিলেই বই হবে। রেদওয়ানের সাথে আমার পরিচয় প্রায় আড়াই যুগ আগে। কবিতার স্রোত আমাদের একত্র করেছিল। আজকাল দেখা সাক্ষাৎ কম হলেও হৃদয়ে হৃদয়ে আমরা এক বন্ধনেই আছি হৃদয়ের কাছাকাছি। রেদওয়ানুল হক আমি আমরা কবিতা পথের যাত্রী।

No comments

Powered by Blogger.