ঢাকা যখন ‘বাংলাসাহিত্যের রাজধানী’ ।। আহমদ বাসির

 

ঢাকা যখন ‘বাংলাসাহিত্যের রাজধানী’ ।। আহমদ বাসির

আজকাল একটি কথা প্রায়ই উচ্চারিত হতে শোনা যায়- ‘ঢাকা বাংলাসাহিত্যের রাজধানী’। কবি আল মাহমুদের মুখ থেকে [সম্ভবত] কথাটি প্রথম উচ্চারিত হয়। তারপর ব্যক্তিবিশেষ থেকে নির্বিশেষ; বহুজনের মুখ থেকেই এ-কথাটি শোনা যাচ্ছে। কথাটি শুধু ঢাকার বাতাসেই গুঞ্জরণ তুলেছে এমন নয় মোটেও; খোদ ইংরেজ শাসিত ভারতে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের কেন্দ্রস্থল, বর্তমানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অধীন কলকাতার শীর্ষ কবি-সাহিত্যিকরাও কথাটি অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছেন। পরাধীন বাংলার অন্যতম শীর্ষ কবি ও কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিছুদিন আগে স্বাধীন বাংলার রাজধানী ঢাকা সফরে এসে এ-কথাটিই দ্বিধাহীন উচ্চারণ করে গেছেন।  
‘বাংলা’ একটি মাত্র দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই দেশটির রাজধানী ঢাকা। স্বভাবতই বাংলাভাষা ও বাংলাসাহিত্যের রাজধানীও ঢাকা। ঠিক এই যুক্তিতে কেউ যদি ঢাকাকে বাংলাসাহিত্যের রাজধানী বলে থাকেন, তবে তার ব্যক্তব্যের সাথে বিরোধ করার কোন অর্থ হয় না। সতের কোটি জনঅধ্যুষিত এদেশের প্রায় সব মানুষই বাংলায় কথা বলে। শুধু তাই নয়Ñ বাংলাভাষার সাথে এদের রয়েছে একটি আবেগঘন ত্যাগের সম্পর্ক। এভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এদেরকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে, খুন ঝরাতে হয়েছে, সর্বোপরি তরুণ-তাজা কয়েকটি প্রাণের বিনিময় ঘটাতে হয়েছে। এই খুন ঝরানো, প্রাণ ঝরানো সংগ্রামের চেতনাই আধুনিক পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের চেহারা খোদাই করে দিয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পেছনেও দায় এই একটি ভাষার, যার নাম ‘বাংলা’। এই ভাষাটিকে কেন্দ্র করে যে দেশটির জন্ম, সে দেশটির রাজধানী যদি ঢাকা হয় তবে সে ভাষার সাহিত্যের রাজধানীও ঢাকাই হবেÑ এটি অত্যন্ত সরল একটি সমীকরণ। ফলত এ-অর্থে কথাটি গুরুত্বপূর্ণও নয়, উচ্চার্যও নয়; বরং এর পেছনে অন্যহেতু বর্তমান। সে-হেতুর সন্ধানে আমাদের মুখ ফেরাতে হবে ইতিহাসের দিকে। বুঝে নিতে হবে কথাটি কেনো গুরুত্বের সাথে উচ্চার্য হয়ে উঠেছে এবং উচ্চারিতও হচ্ছে সর্বত্র।
আধুনিক বাংলাসাহিত্যের উন্মেষ, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাÑ এই তিনটি পর্বই সাধিত হয়েছিলো কলকাতা নগরীতে। ঢাকার তুলনায় এটি খুবই নবীন একটি নগরী। এই নগরীর উত্থান হয়েছে নাটকীয় ও রহস্যময় সব পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। ১৬৯৮ সনে সুতানটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর নামক তিনটি জঙ্গলাকীর্ণ গ্রামের জমিদারি লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ধীরে ধীরে এই গ্রামগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি গঞ্জ, যার নাম কলকাতা। গঞ্জ থেকে এটি পরিণত হয় বন্দরে। ১৭৭৩ সনে কোম্পানি শাসিত ভারতের রাজধানী হিশেবে ঘটে কলকাতার বিস্ময়কর উত্থান। ইতিহাসবিদ নারায়ন দত্তের ভাষায়, ‘জন্মের সেই পরম লগ্নেই কলকতার অস্বাস্থ্যকর জলাভূমির মানুষ এক অসুস্থ খেলায় মেতেছিলো। তাতে স্বার্থবুদ্ধিই একমাত্র বুদ্ধি, দুর্নীতিই একমাত্র নীতি, ষড়যন্ত্রের চাপা ফিসফিসানিই একমাত্র আলাপের ভাষা।’ এখানেই ইংরেজ শাসনামলে আধুনিক বাংলাসাহিত্যের এমন এক বলয় তৈরি হয়েছিলো, যে বলয় থেকে বাংলাভাষী কবি-সাহিত্যিক-লেখকদের বিচ্ছিন্ন থাকার কোনো উপায়ই ছিলো না। কোনোও না কোনোভাবে কলকাতামুখী তাদের হতেই হতো। অন্যদিকে কলকাতা যখন গ্রাম ঢাকা তখন ছিলো রাজধানী। ১৬১০ সনে মোঘল সুবেদার ইসলাম খান ঢাকাকে তাঁর রাজধানী বানান। ইতিহাস বলে, এরও প্রায় ছয়শ বছর পূর্বে জনপদের একটি কেন্দ্র হিশেবেই ঢাকার উত্থান হয়েছিলো। স্বাধীন বাংলার রাজধানী ঢাকা ইতিপূর্বেও তিনবার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেছিলো এবং এই ঢাকা অঞ্চলের নাগরী গ্রামেই রচিত হয়েছিলো বাংলাভাষার প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। হাজার বছরের প্রাচীন এই জনকেন্দ্র পর্যটন(?) করে আধুনিক বাংলাসাহিত্যের অন্যতম স্থপতি, কলকাতার সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বলেনÑ ‘ঢাকাতে দুই চারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন পথের পথিক হইবে কাক, কুকুর ও মুসলমান। এই তিনটি সমভাবে কলহপ্রিয় অতি দুর্দম, অজেয়।’ এমনই বিস্ময়কর দৃষ্টিতে ঢাকাকে প্রত্যক্ষ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। কিভাবে এতো নবীন একটি নগরী কলকাতা বাংলাসাহিত্য বলয়ের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো; আর অপেক্ষাকৃত সাতশ বছরের অধিক বয়সী, ইতিহাসের নগরী, ঐতিহ্যবাহী নগরী, সভ্যতার ধারক ঢাকা কিভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের চোখে এতোটা বিস্ময়কর ঠেকেছিলো; সে এক প্রতিক্রিয়াশীল অধ্যায়ের ঘটনা। এ-ঘটনার হেতু তালাশ করা আমাদের ইচ্ছে নয়, সে রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা। আমাদের বরং জানতে ইচ্ছে হয়, কলকাতা শাসিত আধুনিক বাংলাসাহিত্যে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি কতোটা রূপায়িত হয়েছিলো, বাংলার জনজীবন কতোটা চিত্রিত হয়েছিলো? 
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইংরেজ শাসনের সমকালে বাংলায় হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা কম ছিলো না, এখনও নয়। এই মুসলমানদের জীবন-যাপন বহুক্ষেত্রেই হিন্দুর চেয়ে আলাদা, বহুক্ষেত্রেই বিপরীত। তবু তারা দীর্ঘদিন পাশাপাশি অবস্থান করছে, এক ভাষায় কথা বলছে; সর্বোপরি প্রতিবেশীসুলভ জীবন-যাপন করছে এবং নিকট অতীতকাল পর্যন্ত দীর্ঘদিন এরাই এদেশের শাসনভার নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু কলকাতা শাসিত আধুনিক বাংলাসাহিত্যে এদের জীবন কেমন ছিলো? আদৌ সেখানে এদের কোনো উপস্থিতি ছিলো কিনাÑ সে প্রসঙ্গের অনুসন্ধানে সহজেই পরিস্কার হয়ে যাবে, ১৮৭০ সন পর্যন্ত মুসলমানরা যতোক্ষণ না সাহিত্যকর্মে হাত দিয়েছে ততোদিন পর্যন্ত তাদের জীবনও সাহিত্যে ঠাঁই পায়নি। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় বৈকি! গুটিকয় কবি-সাহিত্যিকের আকস্মিক আবির্ভাব না হলে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন আধুনিক বাংলাসাহিত্য পাঠকের মনে কোনো প্রকার আগ্রহেরই উদ্রেক করতো না। মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৮-১৯১১), কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১), বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), দীনেশচন্দ্র সেন (১৮....-১৯....), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ও জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬)-এর মতো কয়েকটি মানুষের জন্ম না হলে ইতিহাসের গতিপথ মনে হয় ভিন্ন হয়ে যেতো। অর্থৎ কলকাতা শাসিত আধুনিক বাংলাসাহিত্য ‘মানুষ’ হয়ে উঠতো না। ‘মানুষ’ হয়ে উঠতো নাÑ কথাটিকে প্রান্তিকভাবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। বিচ্ছিন্নভাবে অনেকেই মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন, যাদের অধিকাংশেরই ‘মানুষ’ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা ছিলো না। কিন্তু সর্বাÍক চারিত্রিক প্রতিফলনের দিকে নজর দিলে পরিষ্কার ফুটে ওঠেÑ আধুনিক বাংলাসাহিত্যে মুসলমানদের জীবন ছিলো নির্বাসিত। অন্তত আমরা যে ক’জনের নাম উল্লেখ করলাম এরাসহ গুটিকয় ব্যক্তির আবির্ভাব না হলে ‘নির্বাসন’ শব্দটি ঠিক জায়গায় বসানো হয়েছে বলা যেতো।
কলকাতা শাসিত বাংলাসাহিত্যের সম্রাট সব বিচারেই রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১)। আমরা তাকেই উদাহরণ হিশেবে পেশ করতে পারি। তিনি শেষ বয়সে জর্মন ভাষা শিখেছিলেন মূলভাষায় মহাকবি গ্যাটের ‘ফাউস্ট’ পাঠ করার জন্য। এতোই ছিলো তার জানবার আগ্রহ। সম্প্রতি এক বিভাষী লেখিকা রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি উপন্যাস লিখেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের প্রখর চৈতন্য-রূপÑ রবীন্দ্রনাথ, তিনি যখন ঘাসের উপর বসতেন, চারপাশ থেকে ঘাসগুলোর গজিয়ে ওঠার শব্দ শুনতে পেতেন। এই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যিনি শরৎচন্দ্রকে লেখা তার এক চিঠিতে বলতে মোটেও দ্বিধা করেননি যে, মুসলমানদের ঘরের কথা তিনি তেমন জানেন না। মুসলমানতো শুধু ঘরেই বাস করে না, সমাজেও বাস করে। তিনি, রবীন্দ্রনাথ মনে হয় তাদের সমাজের কথাও জানতেন না। ফলে তিনি মুসলমানদের নিয়ে লিখতে তার দ্বিধার কথাও প্রকাশ করেছেন। এই বাস্তবতা যে চিত্রটি আমাদের সামনে হাজির করে তা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কলকাতা শাসিত সাহিত্য দৃষ্টভঙ্গির স্বরূপ। এখানে মুসলমানদের জীবন পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে, পথের পাশে সরিয়ে রাখা কোন বস্তুর মতো। 
এই অবমাননাকর অবস্থা থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে যারা উদ্ধার করেছেন তারা সর্বোতভাবে পূর্ববঙ্গীয়। পূর্ববাংলাই এদের সৃজন চিন্তনের ক্ষেত্র। নজরুল কিংবা শহীদুল্লাহর কথাই ধরা যাক। পশ্চিমবাংলায় জন্মগ্রহণ করেও পূর্ববাংলার সাথে এদের যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে সে সম্পর্ক যে প্রাণের, নাড়ির; এটা বলারও অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে বিস্ময়করভাবে মীর মশাররফ একেবারেই কলকাতামুখী হননি। কলকাতা ও কলকাতা কেন্দ্রিক তৎকালীন সেরা সব সাহিত্য পত্রিকাকে এড়িয়ে তিনি কুষ্টিয়ায় বসে নিভৃতে কালজয়ী সব সাহিত্য রচনা করেছেন একের পর এক। এতো বিশাল মাপের একজন সাহিত্য ব্যক্তিত্ব কলকাতাকে পরোক্ষভাবে উপেক্ষাই করেছেন।
পূর্ববাংলার প্রকৃতি ও জীবন এদের এতটা আপন হয়ে ওঠার ফলেই আধুনিক বাংলাভাষা ও সাহিত্যে মুসলমানদের চেহারা ফুটে উঠতে শুরু করে। উপেক্ষিত জনজীবন এবার মাঝপথে এসে দাঁড়ায়, রাজপথে এসে দাঁড়ায়। আধুনিক বাংলাভাষা ও সাহিত্যে সহসাই মুসলমানরা যে অবস্থান গ্রহণ করে তা বৈপ্লবিক। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টিতে এদের ভূমিকাও এখানে বিচার্য নয়; বরং এরাই আধুনিক বাংলাভাষা ও বাংলাসাহিত্যকে ‘মানুষ’ করে তোলেন। ‘মানুষ’ করে তোলাÑ বিষয়টি আরেকটু খোলাশা করে বলা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারত তীর্থ’ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন/শাকহুন দল, পাঠান মোঘল এক দেহে হল লীন!’ বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে এই ‘এক দেহে’র স্বরূপ পাওয়া গেলো না। এটা শুধু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেই নয়Ñ বরং ধর্মান্তরিত [হিন্দু থেকে খ্রিস্টান] মাইকেলসহ ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র; এমনকি সত্তেন্দ্রনাথ দত্ত, শরৎচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিকÑ কারো সাহিত্যেই এর রূপায়ন দেখা গেলো না। বিশেষ করে রবীন্দ্র-সাহিত্যের এই বিশিষ্ট দুর্বলতাকে ঢেকে রাখারও নানা প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে এই অভিযোগ থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন; কিন্তু পারেননি, ব্যর্থ হয়েছেন। একটি উদাহরণ বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে তুলবে। পরাধীন বাংলার বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ‘বাংলাসাহিত্যে মুসলমান সমাজ ও চরিত্র’ শিরোনামে একটি পিএইচডি থিসিস প্রণয়ন করেন। ড. লায়েক আলী খানের এই গবেষণাকর্মটি গ্রন্থাকারেও প্রকাশ পেয়েছে। এ-গ্রন্থে তিনি রবীন্দ্র-সাহিত্যে মুসলিম সমাজ ও চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথম দিকে এরূপ মন্তব্য করেনÑ ‘সমগ্র রবীন্দ্র-সাহিত্যে মুসলমান সমাজ-জীবন ও চরিত্র তুলনামূলকভাবে কম হলেও একথা স্বীকার করেত হবে, রবীন্দ্রনাথ-ই ভারতবর্ষীয় তথা বাঙালি মুসলমান সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি সুবিচার করেছেন।’ আলোচনাকে বিস্তারিত করতে গিয়ে একপর্যায়ে লেখক আমাদের জানানÑ ‘রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলির প্রেক্ষাপট যে পূর্ববঙ্গের মাটি মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ফলশ্র“তি এতো সকলেই মানেন। আর পূর্ববঙ্গের রায়ত প্রজাদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য। ফলে সঙ্গত কারণে জমিদার রবীন্দ্রনাথ মুসলমান প্রজাসাধারণ সম্বন্ধে কৌতূহলী হতেই পারেন। কিন্তু দু:খ এইখানে যে এই মুসলমান সমাজ তাঁর রচিত গল্পে তেমন নেই, যেমন আছে কল্পনা ও রোমান্স নির্ভর প্লট ও পাত্র-পাত্রী।’ আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করি, একজন গবেষক, লেখক কিভাবে রবীন্দ্রনাথকে সংশ্লিষ্ট অভিযোগ থেকে মুক্তি দিতে গিয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। লক্ষ্যনীয়, যে রবীন্দ্রনাথকে লেখক ভারতবর্ষীয় তথা বাঙালি মুসলমান সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি সুবিচারকারী বলে উল্লেখ করেছেন, সে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে একই রচনায় লেখককে দু:খ প্রকাশ করে বলতে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের গল্পে মুসলমান সমাজ ততোটা নেই যতোটা আছে কল্পনা ও রোমান্সনির্ভর প্লট ও পাত্র-পাত্রী। অথচ এইসব ছোটগল্পকে পূর্ববঙ্গের মাটি-মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ফলশ্র“তি বলতেও লেখক দ্বিধা করেননি। এই হলো রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য; এবং অন্যকোনো হিন্দু লেখক-সাহিত্যিককে নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথের [পারিবারিক রবীন্দ্রনাথ অবশ্য হিন্দু নন, ব্রাক্ষ্ম] চেয়ে উদার ভাবার সুযোগ নেই। 
অন্যদিকে মশাররফ, কায়কোবাদ, নজরুলসহ মুসলিম সমাজের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকের কবিতা ও সাহিত্যে সেই অভেদ শিল্প-সংস্কৃতির রূপরেখা অকপটে পরিদৃশ্য হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র নজরুলের কবিতা ও সাহিত্যে ‘মানুষ’ যেভাবে বিশ্বাসের বিশাল ফারাক থাকার পরও কেবলমাত্র মানুষ হিশেবে এক দেহে লীন হতে দেখা যায় তা নজরুলের সৃষ্টিকর্মের পাশে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মকে অনুজ্জ্বল করে দেয়। সোজা কথা, তখন এক নজরুলের সাথে দশ রবীন্দ্রনাথকে বিনিময় কারাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। রবীন্দ্রনাথ ধর্ম-বিরূপ ছিলেন না বটে; তবে নজরুলের মতো ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণির ঊর্ধ্বে মানুষকে মানুষ হিশেবে এক কাতারে বিবেচনা করতে পারেননি। কেন যে অনেক স্বাধীন-চিন্তার মানুষও এই উপলব্ধিকে স্পর্শ করতে গিয়েও হাত গুটিয়ে নেন, তা আমাদের অজানা। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ ভাষা ও সাহিত্যে উপেক্ষিত জনজীবনের ছবি এঁকেই ক্ষান্ত হননি, উপেক্ষিত জীবন-সংশ্লিষ্ট শব্দরাজির সেবা করেই ক্ষান্ত হননি; তারা মানুষকে দেখেছেন অখন্ড দৃষ্টিতে এবং সামগ্রিক জনজীবন ও ভাষাকে তাদের চর্চার বিষয়ে পরিণত করেছে। এদের জ্ঞানস্পৃহা ও দানস্পৃহার মধ্যে কোন কার্পণ্য ছিলো না। এরা মুসলমানদের প্রাণের কথাকে নিজেদের প্রাণের কথা হিসেবে যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন, হিন্দুর প্রাণের কথাকেও ওদের প্রাণের কথা হিসেবে তেমনই গুরুত্ব দিয়েছেন। এরা মুসলমান হয়েও হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষের। এমন গুটিকয় ব্যক্তির অবিস্মরণীয় আবির্ভাব না হলে কলকাতা শাসিত আধুনিক বাংলাসাহিত্যের বর্তমান চেহারাটি দাঁড়াতো না। একজন জসীমউদ্দীনের কথাই ধরা যাক। তার কবর কবিতা রচিত হওয়ার আগে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কবরের কোন বিশেষত্বই ছিলো না। অথচ তখনও এদেশের মানুষ মারা যেতো এবং তাদের অধিকাংশেরই(!) কবর হতো; কমসংখ্যক মানুষেরই শ্মশানে যেতে হতো। তবুও বাংলাসাহিত্যে কবরের কোনো ঠাঁই ছিলো না। কায়কোবাদের কথাও আমরা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে পারি। এদেশে তখনও হাজার হাজার মসজিদ ছিল, দৈনিক পাঁচবার উচ্চস্বরে আজান হতো; কিন্তু কায়কোবাদ আজান কবিতা রচনার পূর্বে আজান আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কোনরকম বিশেষত্বও পায়নি। এর সাথে কোন মানুষের প্রাণের সম্পর্ক গড়ে উঠতেও দেখা যায়নি এসব সাহিত্যে। আর নজরুল ইসলামতো তাঁর ‘মুসলমানি ঢং’ দিয়েই সবকিছু কাত করে ফেলেছেন। আধুনিক বাংলাসাহিত্যের এই দুর্গতি ঘোচাবার জন্যই উল্লেখিত এদের জন্ম হয়েছে। সময় এদের জন্মকে অনিবার্য করে তুলেছে। এদের আগমনে শতাব্দীকালের ব্যবধানে বাংলাসাহিত্যের চেহারাটা পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। ফলে বাংলাসাহিত্যের প্রকৃত রূপটি বিনির্মিত হয়। এই সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সূচনা করে এবং বাংলাসাহিত্যের কেন্দ্র কিংবা রাজধানীও পরিবর্তিত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দিকে না তাকালে চলমান বাংলাসাহিত্যের প্রকৃত চেহারাটি এখন যে আর দেখা যাবে না তা সর্বৈব সত্য। 
ঊনিশ’শ সাতচল্লিশের স্বাধীনতার ফলে বাংলাসাহিত্য কলকাতার একচ্ছত্র শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে। ততোদিনে বাংলাসাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে মুসলমানরা তাদের বিজয়ী অবস্থান গ্রহণ করেন। ইংরেজ শাসনের যাঁতাকল থেকে মুক্তি এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি লাভের ফলে বাংলাদেশের তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা বাংলাসাহিত্যের দ্বিতীয় প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই ঢাকাকে কেন্দ্র করেই তখন নতুন উদ্যমে রচিত ও প্রকাশিত হতে থাকে উপেক্ষিত জনজীবনের আর্তি। ঢাকা কেন্দ্রিক এই প্রকাশ শতভাগ স্বতস্ফুর্ততা লাভ করে। দীর্ঘদিনের অধীনতা থেকে মুক্তি পেয়ে দৃঢ়পদক্ষেপে চলতে শুরু করে বাংলাদেশ। সহসা এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে জীবন। ‘অধীনতা মানুষের জীবনীশক্তিকে কাঁচা-বাঁশে ঘুণ ধরার মতো ভুয়া করিয়ে দেয়।’ এ-সত্য কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২০ সালেই উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি যে প্রাণের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আর যে মুক্তির প্রবল আকাংখায় উদ্ভোদিত হয়েছিলেন, সাতচল্লিশ সেই মুক্তিকে বয়ে এনেছিলো। এই মুক্তি বাংলাদেশের উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীর মেধা ও পরিশ্রমের প্রমাণ দানের সুযোগ সৃষ্টি করেছিলো। আর এই সুযোগেই তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে তাদের মেধা ও প্রতিভার দৌড়। কলকাতা শাসিত বাংলাসাহিত্য যাদেরকে কৃষক ছাড়া আর কিছুই ভাবতে চাইতো না তারাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে এমনভাবে নিজেদের বিকশিত করে তুলেছে যে বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে তারা একটি আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ফেলেছে। এই রাষ্ট্রের কেন্দ্রভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে ঢাকা এবং ঢাকাকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছিলো এ-রাষ্ট্রটি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পর বাঙালি মুসলমানের হাতে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের ধারা প্রবলতর হয়ে ওঠে এবং স্বল্পকালের ব্যাবধানে ঢাকা-ই হয়ে ওঠে বাংলাসাহিত্যের কেন্দ্রস্থল। 
এই ঢাকাকে দাবিয়ে রাখার জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে যেসব কর্মতৎপরতা পরিচালিত হয়েছে তা উল্লেখ করার জন্য দীর্ঘ পরিসরের একটি গ্রন্থ রচনা জরুরী হয়ে পড়বে; রবং আমরা এখানে দুটি মাত্র ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেনÑ ‘আমাদের দেশে যখন স্বদেশী আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল তখন আমি তার মধ্যে ছিলাম। মুসলমানরা তখন তাতে যোগ দেয়নি, বিরুদ্ধে ছিল।’ এই স্বদেশী আন্দোলন ছিলো ঢাকা কেন্দ্রীক একটি স্বতন্ত্র প্রশাসন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে। রবীন্দ্রনাথ না হয় ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ ঠেকাতে স্বদেশী আন্দোলন করেছেন, রাখিবন্ধন উৎসব করেছেন, গঙ্গাস্নান করেছেন, প্রার্থনা করেছেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল / বাংলার বায়ু বাংলার ফল / পূণ্য হউক পূণ্য হউক / পূণ্য হউক হে ভগবান’ কিংবা ঐ সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় গীতিকবি গগণ হরকরার জনপ্রিয় গান ‘আমি কোথায় পাব তারে / আমার মনের মানুষ যে রে’ প্যারোডি করেছেন অখন্ড বাংলার চেতনায় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’; কিন্তু এই প্রশ্নের হাত থেকে কে আমাদের রেহাই দেবে যে, রবীন্দ্রনাথ কেনো ‘শিবাজী উৎসব’ রচনা করলেন, কেনো এক-ধর্ম-রাজ্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলেন? অপর ঘটনাটি হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা। ১৯১২ সনের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয় তাতেও সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলাদেশের বুকে, যে ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ তিনি সহ্য করতে পারেননি সেই ‘বঙ্গমাতা’র বুকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচরণ করার কি আদৌ কোনো কারণ থাকতে পারে? যদি থেকেই থাকে তবে তা হচ্ছে বাংলাদেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে [পূর্ববাংলার মুসলিম চাষি পরিবারের সন্তানদের] মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পথে প্রত্যক্ষভাবে বাধার সৃষ্টি করা, এক-ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার পথে এদেরকে অন্তরায় ভাবা। কিন্তু এতো বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করেও ভালো কোনো ফল লাভ করা সম্ভব হয়নি; বরং ক্রমান্বয়ে ঢাকা তার আপন ঐতিহ্যে বিকশিত হয়ে ওঠে। পারতপক্ষে ঢাকা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিকশিত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার সাথে সাথে ঢাকা কেন্দ্রীক বাংলাসাহিত্যও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। 
অন্যদিকে, দিল্লীর অধীনতা ও সর্বভারতীয় ভাষা হিন্দির আগ্রাসনের কবলে পড়ে কলকাতা কেন্দ্রীক বাংলাসাহিত্য। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো কলকাতা কেন্দ্রীক সেইসব নাক উঁচা কবি-সহিত্যিকরা যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে নির্ঘাত ক্ষোভে ও লজ্জায় আÍবিসর্জন দেয়ার কথাই ভাবতেন। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছেÑ বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অদূর ভবিষ্যতে ঢাকাকেই যে আশ্রয়স্থল বানাতে হবে তা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বর্তমান সময়ে কলকাতায় বসে যারা বাংলাসাহিত্যের চর্চা করছেন তাদেরকেও একটি লেখা তৈরি করতে বসলে বাংলাদেশের পাঠকদের দিকে মুখ তুলে তাকাতে হয়। এর পেছনে কারণ একটাই, আর তা হলো পশ্চিম বাংলায় কিংবা ভারতে সর্বভারতীয় হিন্দি ও আন্তর্জাতিক ইংরেজির মারাÍক প্রভাবে বাংলাসাহিত্য পাঠকের সংখা দ্রুত গতিতে কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিকাশ তথা অগ্রগতির তালে তালে বিকশিত হচ্ছে বাংলাভাষা ও সাহিত্য, বাড়ছে অগণন পাঠক।
এই এতিহাসিক পট-পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বাঙালি মুসলমানের প্রতি দীর্ঘকালের বঞ্ছনা-লাঞ্ছনা-উপেক্ষার ফলস্বরূপ। গোটা ঔপনিবেশিককালে বাঙালি মুসলমানকে একই সাথে একটি বিদেশি ও একটি স্বদেশী শক্তির সাথে নানাভাবে যুঝতে হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনাবোধের উন্মেষ প্রবলভাবে সাধিত হয়েছে। পাশাপাশি স্বদেশী ভাষা ও স্বদেশভূমির প্রতি তাদের অধিকারবোধের উন্মেষও ঘটেছে প্রবলভাবেই। এই এককেন্দ্রিক অথচ বহুমুখী বোধের বিকাশ ঘটাবার জন্য আÍবিকাশের যে স্তম্ভটি জরুরী হয়ে পড়েছিলো, সেটির নাম নজরুল ইসলাম। নজরুল মুসলমানদেরকে যে সর্বজনীন সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেছেন বাংলার মুসলমান তাতে ব্যাপক সফলতার পরিচয় দিয়েছে। নজরুল সর্বজনীন সাহিত্যের যে দিগন্ত সৃষ্টি করেছেন সে পথ ধরে বাঙালি মুসলমান ব্যাপক ঔদার্যের সাথে মুক্তচিত্তে বাংলাসাহিত্যের ভান্ডারটি ভরিয়ে তুলেছে। 
সাতচল্লিশের পর ব্যাপকভাবে বাঙালি মুসলমান কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা ঢাকায় চলে আসার পর কলকাতা তার পূর্বরূপ ফিরে পেয়েছে। কলকাতার সাহিত্যে মুসলমানি জীবন বলে পূর্বের মতোই তেমন কিছু এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে বিশেষ ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে বাঙালি হিন্দু তথা কলকাতা শাসিত সাহিত্য বাংলার সর্বজনীন সাহিত্য হয়ে উঠতে পারেনি। নজরুলের প্রণোদনায় বাঙালি মুসলমানের হাতেই রচিত হয়েছে বাংলাভাষার সর্বজনীন সাহিত্য। ফলে মাঝখানে কয়েকটি দশক বাদ রাখলে কলকাতা শাসিত সাহিত্য বাকি সময়কালে বাংলার বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর জীবনের সাথে সম্পর্কহীনতার দায়ে দুষ্ট। মাঝখানের কয়েকটি দশক মুসলামনদের চূড়ান্ত উত্থানের সময় ছিলো বলে ঐ সময়ে তারা কলকাতায় তাদের স্ব-মর্যাদায় অবস্থান নিয়েছিলেন। ফলে সাতচল্লিশের বাংলা ভাগও অনিবার্য হয়ে পড়েছিলো। মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক গতি প্রবাহের সাথে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির গতিপ্রবাহের একটি আন্তসম্পর্ক বিদ্যমান। ফলে ১৯০৫ সালে যারা বাংলা ভাগের বিরোধিতা করেছিলো তারাই সাতচল্লিশে বাংলাকে ভাগ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। কারণ ছিলো, বাংলার মুসলমানের কলকাতার রাজনীতি ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অবস্থান গ্রহণ। এই অবস্থানকে কলকাতা থেকে হটিয়ে দেয়ার জন্যই এমনটি তারা করেছিলো; কিন্তু এই শক্তি দেশভাগের মাধ্যমে সহঅবস্থান থেকে স্বতন্ত্র অবস্থানে এসে নিজেদের আরও ব্যাপকভাবে বিকশিত করার সুযোগ লাভ করেছে। এ ব্যাপারে আমরা প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. অম্বেদকারের একটি উক্তির উল্লেখ করতে পারিÑ ‘বাঙালি হিন্দুদের বাংলা ভাগের বিরোধিতা কারার কারণ ছিলো বাঙালি মুসলমান [পূর্ববঙ্গের মানুষ] যাতে যোগ্যস্থান না পেতে পারে সেই আকাঙ্খার বাস্তবায়ন।’ ড. অম্বেদকার আশংকা প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, বাংলা ভাগের বিরোধিতা করে এবং সেই সাথে স্বরাজ লাভের দাবি করে হিন্দুরা একদিন মুসলমানদের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় বঙ্গের শাসক করে তুলবে। সেই আশংকার অর্ধেক ইতোমধ্যে সত্যে পরিণত হয়েছে। এই হিন্দুরাই সাতচল্লিশে ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ করে বাংলার মুসলমানদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জনের পথ সুগম করে দিয়েছে। মূলত বাংলার মুসলমানদের অর্জিত অবস্থানকে আবারো নড়বড়ে করে দেয়ার মানসে দ্বিতীয়বারের মতো হিন্দুরাই সাতচল্লিশে বাংলাকে ভাগ করেছিলো। কিন্তু রাজনীতি ও ইতিহাসের গতিকে তারা আর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। তারা ভেবেছিলো, কলকাতা থেকে মুসলমানদের হটিয়ে দিলেই বাংলার মুসলমানদের অকূলে ভাসিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু ঢাকা তাদের এই আকাঙ্খার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্য-সংস্কৃতির রাজধানী ঢাকাই হয়ে উঠেছে সমগ্র বাংলাসাহিত্যের রাজধানী; শিল্প-সংস্কৃতিরও নয় কি? 
ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলাসাহিত্যের এই ব্যাপক বিকাশের উল্টোপিঠে কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলাসাহিত্যের আগ্রাসনের মুখে পতিত হওয়ার কারণ হচ্ছে কলকাতার সর্বজনীন সাহিত্য সৃষ্টিতে ব্যর্থতা। কলকাতা কেন্দ্রিক কথাসাহিত্যে কতো দেশ, দুনিয়া, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী, দুর্গমসব অঞ্চলের রূপকথার মতো মাসুষদের কথা কতো দরদের সাথে উল্লেখ হয় কিন্তু মুসলমান সেখানে আজো উপেক্ষিত। এই উপেক্ষা যতোই বেগবান হয়েছে ঢাকা ততোই শক্তি-সঞ্চয় করেছে এবং বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে সর্বজনীনতা দানে অকৃপণ ভূমিকা পালন করে চলছে।
এই ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলোকে ঢাকাকে যদি বাংলাসাহিত্যের রাজধানী বলে গুরুত্বের সাথে উচ্চারণ করা হয় তবে তা যর্থাথই। সাতচল্লিশের বিভাজনের পরও কলকাতার যেটুকু গুরুত্ব ছিলো একাত্তরের স্বাধীনতার পর তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হওয়ার পরও কলকাতাকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য যেটুকু হীনমন্যতা কারো কারো মনে অবশিষ্ট ছিলো তা-ও ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় চেতনার বিকাশে ক্রমেই বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এই কিছুকাল আগেও কলকাতামুখীনতার একটি প্রবণতা অবশিষ্ট ছিলো। কিন্তু একুশ শতকের প্রারম্ভ থেকেই এ-প্রবণতারও অবসান হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে ভিন্ন প্রেক্ষাপট। আগে কলকতা থেকে বড় কেউ একটা ঢাকার দিকে আসতো না। এখন অনেকেই ঢাকামুখী। ঢাকা থেকে প্রকাশিত কাজগুলোর দেয়া স্বীকৃতি এখন বাংলাসাহিত্যে সর্বাধিক গুরুত্ববহ। আর এটা একারণেই যে, বাংলাসাহিত্যের রাজধানী এখন ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.