কবিতা আমার বোধের আকাশের ধুব্রবতারা ।। তাহমিনা শিল্পী

 
কবিতা ভাবনা
কবিতা আমার বোধের আকাশের ধুব্রবতারা
তাহমিনা শিল্পী 

কবিতা নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে ভাবনাটি সামনে চলে আসে। সেটি হল, কবিতা কি? 

মুখস্তবিদ্যা থেকে গড়গড় করে বলে দিতেই পারি, আভিধানিক অর্থে কবিতা হলো কাব্য, পদ্য, শ্লোক, কবির কল্পনামিশ্রিতি ছন্দময় রচনা। যা সাহিত্যের আদিমতম এবং গুরুত্বপূর্ণ শাখা। কিন্তু কবিতার বিস্তার ও পরিধি এতটাই গভীর যে নির্দিষ্ট কিছু শব্দে কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তথাপি খুব সহজভাবে বলা যেতে পারে, কিছু নান্দনিক শব্দে, উপমা-অলংকার ও ছন্দে নির্দিষ্ট সময়ের কিংবা বিষয়ভিত্তিক আবেগকে প্রকাশ করা হয় সাহিত্যের যে শাখায় তাকে কবিতা বলা হয়।

কবিতা মুলত সমাজের প্রতিচ্ছবি, ইতিহাস ও কালের সাক্ষী। পৃথীবির প্রায় সব দেশেই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে কবিতা লেখা হয়। এমনকি যখন মানুষ লিখতে পারত না, তখনও মৌখিকভাবে কবিতা রচনা করত। কবিতা সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক।কবিতা সময়ের কথা বলে, জীবনের কথা বলে। কবিতা একটি জাতিকে স্বপ্ন দেখায়, সহস ও উদ্দিপনা জাগায়। কবিতা মানবতার মুক্তির পথ দেখায়। যুগে যুগে কবিতা আন্দোলনে, অন্যায়ের প্রতিবাদের বলিষ্ঠ মাধ্যম।

কবিতার সাথে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য আত্মীয়তা। কবিতায় ফুলের ভাষা, সবুজের আকুতি, মেঘমালার অভিমান, প্রজাপতির দুরন্তপনা, পাখিদের কলরব ইত্যাদি প্রকাশের পাশাপাশি মানব জীবনের সুখ-অসুখ, আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির পূর্ণাঙ্গ দৃশ্যগুলো ছোটছোটভাবে উপমা অলংকারের মাধ্যমে অর্থবহ বাক্যে কবিতায় প্রকাশ হয়।

কবিতা সময় ও ঘটনাকে ধারণ করে। কবি তার আত্মোপলব্ধির সাথে কল্পনারস মিশিয়ে ও শব্দের প্রয়োগে শ্বাশত কালের ধারনায় কবিতায় রূপ দেন। তাই কবিকে সময়ের সাথে সাথে বদলাতে হয় তার দৃষ্টিভঙ্গি। লক্ষ রাখতে হয় যথাযথ বাক্যের বুননের দিকে। এতে করে সময়ের সাথে সময়ের সাঁকো তৈরী হয়। কবিতাকে সত্যে ও ব্যাপ্তিতে পৌঁছে দেয়া যায়।

কবিতা লেখার সময় কবির কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। একটি অস্থির সময়ে রচিত কবিতায় সময়ের অস্থিরতা তুলে ধরার পাশাপাশি সুন্দর ও শান্তির পৃথিবীর কথাও লিখতে হয়। তাতে মানুষের চৈতন্য ফিরে আসে। তারা আত্মসমালোচনা কওে এবং পৃথিবীর মঙ্গলে কাজ করে। কাল থেকে কালে কবিতার বিষয়বস্তু ও ভাষা ভিন্ন হয় এবং মানব হৃদয়ের গভীরতম অনুভবেই বেঁচে থাকে কবিতা এই বিষয়টি মাথায় রেখেই এমন কবিতা লিখা উচিত যা সাধারণের জীবনের সাথে জড়িয়ে কবিতাকে নিজের বলে ভাবে এবং কবি ও কবিতা কাল অতিক্রম করে।

এই আলোচনার প্রেক্ষিতে সবশেষ ভাবনা, আমি কেন কবিতা লিখি? 

তন্নতন্ন করে খুঁজেও যথার্থ উত্তর পাই না। দিশেহারা হয়ে আবার কবিতার কাছেই প্রশ্ন রাখি।

কবিতা আমাকে যে উত্তর দেয়, তার সারাংশটুকু বলি-
কবিতার প্রতি অপার মুগ্ধতা, মায়া এবং ভালোবাসা থেকে একান্ত ভাবনায় মিশে গিয়ে কবিতা আমারই একটি অংশ হয়ে গিয়েছে। কবিতা আমার অনুভূতির আয়না। তাই সবরকম পরিবেশ-পরিস্থিতিতে নিজের অনুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি নিজের সাথে সংযোগ সাধনের গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম কবিতা। কবিতার মাঝেই খুঁজে পাই অতীত ও বর্তমানের নিরবিচ্ছন্ন প্রতিফলন, ভবিষ্যতের সরল দিক নির্দেশনা। কবিতা একদিকে যেমন অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্যের দাবানলে জ্বলে ওঠা সমাজের অগ্নিনির্বাপক হয়ে ওঠে। অপরদিকে কবিতায় গাঁথা শব্দের যাদুতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের মন অধিকার সচেতন হয়, বিদ্রোহী ও সাহসী হয়ে ওঠে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়। খুলে চায় নিপিড়নের পাতানো জাল, ভাঙতে চায় দাসত্ব আর পরাধীনতার শেকল। কবিতার বিশুদ্ধ বাতাসের ঘ্রাণে আত্মাশুদ্ধ হয়। মানুষ ঈশ্বর প্রেমে নমনীয় ও মানবিক হয়ে ওঠে। পরস্পরের জন্য অনুভব করে প্রেম, মমতা ও ভালোবাসা। সহানুভূতি ও সৌহার্দের অংগীকারে বাঁধা পরে একে অন্যের সাথে। কবিতাই পারে জীবনের সাথে জীবনকে বেঁধে রাখতে পরম মায়ায়, নির্ভরতায়। কবিতায় জাগ্রত হয় প্রকৃতি ও প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা। পরিবেশ ও প্রতিবেশকে আপন করে ভাবার ও দায়িত্বশীল হয়ে রক্ষার প্রচেষ্টায় নিমগ্ন হওয়ার। 

এককথায় বলতে গেলে কবিতা আমার বোধের আকাশের ধ্রুবতারা। চেতনার চকচকে রোদ্দুর। কবিতাই আমার সবচেয়ে ভালো ও বিশ্বস্ত বন্ধু।

No comments

Powered by Blogger.