আবদুল হাই শিকদার : বাংলাদেশের সত্তার কবি ।। ফকির আব্দুল্লাহ আল ইসলাম
আবদুল হাই শিকদার : বাংলাদেশের সত্তার কবি
ফকির আব্দুল্লাহ আল ইসলাম
বাংলাদেশের সত্তার কবি আবদুল হাই শিকদার ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ সালের পহেলা জানুয়ারি দেশের সর্বউত্তরের নান্দনিক জেলা কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় বহমান নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি দুধকুমার নদী তীরের জনপদ দক্ষিণ ছাট গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
লাল-সবুজের প্রিয় কবির পিতা প্রখ্যাত কৃষিবিদ ওয়াজেদ আলী এবং মা হালিমা খাতুন। যাঁরা উভয়েই ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ছাত্র। কবির নামটিও ভাসানী হুজুর রেখেছিলেন। নৈসর্গিক পরিবেশ ও ভাসানীর ঐতিহাসিক রাজনৈতিক নিবিড়তার ছায়ায় বেড়ে উঠেছেন আবদুল হাই শিকদারের আশৈশব। তাইতো পরিবারের আর সবার মতো প্রাণের মায়া ত্যাগ করে দেশপ্রেমের তাগিদে কিশোর জীবনে ঘটমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে নিজেও ভুল করেন নি!
কবির পেশাগত জীবনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত জীবন-জীবিকার প্রধানতম পেশা সাংবাদিকতা। ১৯৮১ সালে সাপ্তাহিক সচিত্র স্বদেশের পর সাংবাদিকতার ধারাবাহিক স্রোতে মাসিক এখন (৮৬-৮৭), দৈনিক মিল্লাত (১৯৮৭-১৯৯৪), সাপ্তাহিক বিচিত্রা (১৯৯৪-১৯৯৭), দৈনিক ইনকিলাব (১৯৯৭-২০০৪) এ কর্মরত ছিলেন। এরপর ২০০৪-২০০৫ সালে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ফিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পরবর্তীতে ২০০৭ সাল থেকে দৈনিক আমার দেশ-এর সিনিয়র সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। পরপর দুইবার ঐতিহ্যবাহী 'ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে'র সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ২০১৩-২০১৬ সাল নাগাদ সফলতার সাথে দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি একসময় নজরুল ইনস্টিটিউট এর নির্বাহী পরিচালক ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে খেদমত করেন। অধ্যাপনা করছেন বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কবি আবদুল হাই শিকদার ছাত্রাবস্থায় লেখালেখি শুরু করেন ৭০-এর দশকে। ১৯৭৭ সালে শাব্দিক সাহিত্যপত্র নামের একটি সাহিত্য-কাগজের সম্পাদকও ছিলেন তিনি। সাহিত্যে তাঁর চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে ৮০-এর দশকে। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, শিশু সাহিত্য, চলচ্চিত্র, গবেষণা, ভ্রমণ কাহিনী, সম্পাদনাসহ সাহিত্য-সংস্কৃতি-সভ্যতা-রাজনীতির সকল ডালে-ডালে, পাতায়-পাতায় সরব উপস্থিতি তাঁর। এ পর্যায়ে কবির প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২০টির ওপরে! আশি লক্ষ ভোর-১৯৮৭ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এরপর একে-একে প্রকাশিত হয়েছে, আগুন আমার ভাই-১৯৯১, রেলিঙ ধরা নদী-১৯৯২, যুগলবন্দী ভূগোলময় (যৌথ)-১৯৯২, মানব বিজয় কাব্য-১৯৯২, এই বধ্যভূমি একদিন স্বদেশ ছিলো-১৯৯৭, লোডশেডিং নামিয়াছে-২০০১, দুধকুমারের জানালাগুলি-২০০১, কবিতা সমগ্র-২০০২, সুন্দরবন গাথা-২০০৩, মেঘমাতৃক ধাতুতান্ত্রিক- ২০০৪, শ্রেষ্ঠ কবিতা-২০০৬, হাফিজ, এই যে, আমার দরখাস্ত-২০০৬, অতি মুরগী হইল-২০০৭, নির্বাচিত প্রেমের কবিতা-২০০৮, কসম-২০১০, কে সিরাজদৌলা কে মীরজাফর-২০১০, কবিতা সমগ্র-২ ২০১২, তারাউজিয়াল গ্রামে বৃষ্টি নামলো- ২০১৫, ইবাদতগুলি প্রার্থনাগুলি-২০১৬, নদীর মেয়ে বাংলাদেশ-২০১৮, ইশক আবাদ-২০২২, সিগারেট টানতে টানতে চলে যাই-২০২২ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি-স্বরূপ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০০৩-সহ দেশ ও বিশ্ব-সমাজের বিপুল পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
ব্যক্তি-জীবনে তিনি পরম ওয়াজেদ শিকদার ও প্রকৃতি ওয়াজেদ শিকদার এক ছেলে, এক মেয়ের জনক। সহধর্মিণী কবি আবিদা শিকদার।
আশি লক্ষ ভোর শিরোনামে সৃষ্টি কবি-জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামকরণের পেছনের তরজমা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ! এটার মাধ্যমে মূলত তিনি জানান দিয়েছেন, আশির দশকে কবির বিকাশ ও কাব্যটির প্রকাশের কারণে রূপক অর্থে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের প্রতীক হিসেবে আশি লক্ষ ভোর নামকরণ করা হয়েছে! আরো প্রতীয়মান হয় যে, কাব্যসাহিত্যে কবি শিকদারের রাজত্ব আশি লক্ষ ভোর পেরিয়ে যাবে! অর্থাৎ বাংলা-সাহিত্যে বিশ্ব-সাহিত্যের অংশ হয়ে চির অমরত্ব লাভ করে রয়ে যাবেন পৃথিবীর আলো-বাতাস-মাটিতে; যতকাল পৃথিবী থাকবে!
বাংলাকে অনেক কবিই জেনেছে কিন্তু বাংলাদেশকে কবি আবদুল হাই শিকদারের মতো কবিতায় ও বাস্তবে এতটা আর কেউ পূর্ণাঙ্গ-রূপে জানে নি, ভালবাসে নি! তাই হয়তো এমন বাক্য উচ্চারণ করা তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছে, দেশান্তরী যে হতে চায় হোক, /আমি তো ভাই বাংলাদেশের লোক।
তিনি একটি কাব্যের শিরোনাম দিয়েছেন জিয়াদেশ। মূলত এমন শিরোনামে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বাংলাদেশ তাঁর সঠিক ধারায় তখনই বহমান থাকবে, যখন রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এভাবে জিয়া ও দেশ পাশাপাশি মিলেমিশে একাকার হবে!
তাঁর চির কালজয়ী সৃষ্টি কসম কবিতায় তিনি লিখেছেন,
‘আমি আমার স্বাধীনতার বদলে সোনার
শিকল গলায় পরতে পারি না।
আমি আমার সেনাবাহিনীকে ভাড়া
খাটা বেশ্যায় পরিণত করতে পারি
না।
আমি অভিশপ্ত ইসরাইলকে স্বীকৃতি
দিতে পারি না।
আমি ওয়াশিংটনের মাস্তানির নিচে
মাথা পেতে দিতে পারি না।
আমি তেলআবিবের টাকায়
মানবাধিকার পাচার করতে পারি
না।’
আমার কাছে মনে হয় কসম কবিতাই কবির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য। কবিকে কাব্যসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে মহাকাল-ব্যাপী বাঁচিয়ে রাখতে দীর্ঘ এই একটি অনবদ্য কাব্যই যথেষ্ট।
কবিদের তো আবেগ থাকেই, এটাতো কবিদের কাব্য সৃষ্টিতে প্রধানতম শক্তি। আর পরিবেশ ও খাদ্যাভ্যাস-গত কারণে আমাদের আবেগের মাত্রা সেই প্রাচীনকাল থেকেই আরো বেশি। বলা হয়ে থাকে, আমরা আবেগী জাতি! তো এই প্রভাব বাংলা-সাহিত্যকে অতিরিক্ত আবেগময় করে গড়ে তুলেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চর্যাপদ কাল থেকে আধুনিক যুগ সবখানেই এই অতিরিক্ত আবেগের ছড়াছড়ি-গড়াগড়ি! এক্ষেত্রে কবিতায় বিষয়-ভিত্তিক আলোচনা, ছন্দ-শিল্পের পাশাপাশি সকল কাব্যে বর্ণনার বহুমাত্রিকতায় নাড়ি-নক্ষত্র তুলে আনেন কবি আবদুল হাই শিকদার! তিনি বাংলা-সাহিত্যের বরেণ্য সাহিত্যিক-গবেষক। এভাবেই তিনি সবার থেকে আলাদা এবং অনন্যতম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর সাহিত্য একদিন বিশ্বদরবারে গবেষণার খোরাক হবে; জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সাহিত্য ভাণ্ডার, জীবন ও কর্মের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
কাব্যের চেয়ে বড় দর্শন শাস্ত্র সাহিত্যের অন্য কোনো শাখাতেই নেই। তাই কবিতা বুঝতে হলে কাব্যের গভীরে প্রবেশ করে অন্তর্নিহিত ভাব টেনে বের করে আনতে হয়। তবেই পদ্যের প্রকৃত স্বাদ-গন্ধ ছোঁয়া সম্ভব হয়। ২০২২ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অনন্যা প্রকাশনীর ব্যানারে মুদ্রিত হওয়া তাঁর কাব্যগ্রন্থ, সিগারেট টানতে টানতে চলে যাই । বইয়ের এমন খটকা লাগা শিরোনামও হয়? এই কাব্যে কবি মূলত চলন্ত সময়কে অঙ্কন করেছেন। চারিদিকে আমার বোন ধর্ষিতা হচ্ছে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে লাশ করা হচ্ছে; গুম-গণহত্যা শাক-মাছের মতো! অথচ আমরা বীরের জাতি দেখেও না দেখার ভান করে সিগারেট টানতে টানতে চলে যাচ্ছি! কবি উৎসর্গপত্রে লিখেছেন, যাঁরা আমাকে ভালোবাসে এবং যারা আমাকে ভালোবাসে না। কবি কাব্যটি তাদেরকে উৎসর্গ করেছেন! তিনি জানেন, যাঁরা তাঁকে ভালোবাসে তাঁরা কাব্যটি অবশ্যই পড়বে এবং রসবোধ উপলব্ধি করবে। যাঁরা তাঁর মতের কট্টর বিরোধী তাঁরাও বইটি ছুঁয়ে দেখবে যে শিকদার তাদের কতটুকু ঘোলা জলে নামিয়েছে! আর এর বাইরে যাঁরা আছে তাঁকে চেনে না, বা কবিতা খুব একটা পড়ে না, তাঁরাতো আর কাব্যের স্বাদ পাবে না! এই কাব্যে তিনি দেখিয়েছেন, আমাদেরকে সঠিক ধারায় বাঁচতে হলে, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজির কাছে ছুটতে হবে। যেতে হবে শরীয়তুল্লাহর দরবারে। নজরুল, জসীম উদ্দীন, জীবনানন্দ হয়ে আল মাহমুদ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের যে ধারা গড়িয়েছে, সে ধারায় অবিচল থাকতে হবে। সময়ের অনন্য-অনবদ্য কবি আবদুল হাই শিকদার সিগারেট টানতে টানতে চলে যাই কাব্যে সমকালীন দেশকাল, বিশ্বব্যবস্থার যথার্থ প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করেছেন।
ঘুরে-ফিরে তাঁর কাব্যে স্তন এবং নুনু শব্দ-দ্বয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়, শব্দ দুটি তাঁর নিজের অজান্তে খেয়ালীতে উঠে আসলেও আসতে পারে, আবার ইচ্ছাকৃতভাবেও হতে পারে। তবে সাহিত্য ভাবনায় বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করলে এমন দাঁড়ায়, স্তন মানব জীবনের সবচেয়ে অনুভূতির প্রতীক এবং মানব শিশুর প্রথম পবিত্র আহার তথা বাঁচার অবলম্বন হিসেবে উপস্থাপিত। এবং নুনু শব্দটিও একইভাবে মানব সভ্যতার আদি থেকে অন্ত, অনন্তকাল টিকে থাকার প্রতিনিধিত্ব হিসেবে বিবেচিত! এভাবেই কবিদের ভাবনার বাইরে অনেক তাত্ত্বিক শব্দ গঠিত হয়ে যায়! সাহিত্যের প্রকৃত রস উদ্ভাবনের জন্য খুবই দরকার বিপুল সাহিত্য-সমূহ নিয়ে সঠিক গবেষণা।
আবদুল হাই শিকদারকে আল মাহমুদ পরবর্তী বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লেখনীতে এবং বাস্তব জীবনে দেশপ্রেমের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপনের কারণে তিনি বাংলাদেশের সত্তার কবি। দেশদ্রোহী কালোশক্তি ইতিপূর্বে তাঁকে খতম করার প্রয়াসে ভয়ানকভাবে হত্যা চেষ্টা করেছে! নানামুখী নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বারংবার! তবুও চির অকুতোভয় কলম সৈনিক সত্যের সংগ্রামী রাজপথ ছেড়ে এক চুলও দূরে সরে যান নি! দুনিয়ার জীবনে প্রাণপ্রিয় কবি উস্তাদজী আল্লাহ রহমতে নেক হায়াতে শতবর্ষ পেরিয়ে যান সেই দোয়া জানাই!
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/samoiki
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801720070848
🔗 E-MAILL
samoikionline@gmail.com
No comments