বনলতা সেন ও জীবনানন্দ দাসের পথ চাওয়া আজীবন ।। শিমুল পারভীন

 
শ্রুতিনাটক (কাল্পনিক) 

বনলতা সেন ও জীবনানন্দ দাসের পথ চাওয়া আজীবন 
শিমুল পারভীন

চরিত্রলিপি : বনলতা সেন ও জীবননানন্দ দাস।

বনলতা : সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরের সুদীর্ঘ পথে, জন্ম থেকে জন্মান্তরে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে হালভাঙা নাবিকের মতো বিপর্যস্ত তুমি এসেছিলে বনলতার জীবনে। দু’দন্ড শান্তির আশায়। আমার এলো চুল তোমার চোখে বিদিশার অন্ধকারের মতোন; আমার ধ্রুপদী রূপ বিলুপ্ত শ্রাবস্তী নগরীর অন্ধকারের অবগুণ্ঠনে আবৃত রহস্যময়ীর প্রতিকৃতি যেন।

জীবনানন্দ : দারুচিনি দ্বীপের ভেতর, সবুজ ঘাসের দেশে তোমার আশ্রয়ের আশ্বাস আর অনুরাগের ছোঁয়ায়  আসক্ত আমি। বিম্বিসার অশোকের মতো অজাত শত্রুকে দেখেছি আমি আমার চলার পথে। অবলুপ্ত বিদর্ভ নগরী আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে কলির কামনার বহ্নিশিখায় দময়ন্তীর সুখের সংসার পুড়ে ছাই হবার দৃশ্য। তবু আমি বিসর্পিল অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে চলেছি যেন এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে। এ যাত্রা কবে শেষ হবে আমি জানি না।

বনলতা : ক্লান্তপ্রাণ তোমাকে নিজস্ব পথ থেকে বিচ্যুত করে মোহের দুর্নিবার আকর্ষণ, নিয়ে যায় অন্ধকারের শেষ সীমানায়। তখনই আবির্ভাব আমার। তোমাকে বলতে ইচ্ছে করে ‘বড়ো অসময়ে এসেছো নাবিক, এসেছো ধ্রুপদী এ ঘাটে।’

জীবনানন্দ : পাখির নীড়ের মতো চোখ তোমার বনলতা। এ চোখের নীড়ে হোক ক্লান্তপ্রাণ আমার একটু আশ্রয়। 

বনলতা : ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন।’ কোথায়... জানি চুপ করে থাকবে। তবু অনুচ্চারিত স্বরে তোমার না বলা কথা বুঝে নেই আমি। অন্ধকারে সব প্রিয়তমাদের মুখ মনে করে দু'দন্ড শান্তির আশায় তোমার এই আগমন।

জীবনানন্দ : তোমার চিরন্তন নারীত্বের আর্তনাদ, গার্হস্থ্য জীবনে না ফেরার ব্যথা আমার মনকেও ছুঁয়ে যায়।

বনলতা সেন : হয়তো হবেনা নীড়ে ফেরা, জীবনের চাওয়াগুলো এমনই বহমান নদী আজীবন। এমনই ফুরবো সব লেনদেন। তবুও অনুশোচনার অন্ধকারেও তোমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে মুখোমুখি বসে থাকি আমি নাটোরের বনলতা সেন।

জীবনানন্দ : তোমার প্রেম হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য যদিও জানি তা প্রাত্যহিকতার নয়। ঘড়ায় তোলা জল নয় যেন শান্ত দীঘির জল। আমার মন সাঁতার দেয় নিত্যদিন। শত অন্ধকারেও বেঁচে থাকার এক টুকরো আলোর দেখা পাই।

বনলতা সেন : তাই বুঝি তুমি খুঁজে পাও দু’দন্ডের শান্তির মাঝে জীবনের চরম সত্য আর অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো! তুমি হয়তো কোনদিনই জানবেওনা এই আলোর অবগাহনেই আমাদের বেঁচে থাকা, পথ চাওয়া আজীবন।

No comments

Powered by Blogger.