সাহিত্যে নান্দনিকতা ও মূল্যবোধ ।। ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

 
সাহিত্যে নান্দনিকতা ও মূল্যবোধ
ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

নান্দনিকতার উপলব্ধি একটি বিমূর্ত প্রতিক্রিয়া। এর অবস্থান যতটুকু না বস্তুতে তার থেকে অনেক বেশী পাঠকের আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধি অথবা কল্পনায়। কবিতার মাত্রা, ছন্দ, প্রতীক, রূপক-অলঙ্কার, রচনায় মননশীলতা, মৌলিকত্ব ও মুন্সিয়ানা কিংবা গদ্যের গঠনরীতি অথবা গঠনকাঠামোর মার্জিত সাম্য, ভারসাম্য, সুস্থিতি অথবা জটিল অথচ সুক্ষ্ম ঐক্যতানই নান্দনিকতা নয়। নান্দনিকতা যতটুকু না বস্তুতে তার থেকে অনেক বেশী উপলব্ধিতে। আর এই উপলব্ধি অথবা মূল্যায়নের দায়িত্ব যতটুকু না লেখকের উপর বর্তায় তার থেকে অনেক বেশি হয়তো বর্তায় পাঠকের উপলব্ধি ক্ষমতা ও মূল্যায়ণে। 
শিল্প-সাহিত্য রচনা বা নির্মাণ গভীর চিন্তাশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ফসল। সৃজনশীল লেখার ক্ষেত্রে একজন লেখককে প্রথমেই তার স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র নির্মাণের ধাপটি অতিক্রম করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে একজন লেখকের শিল্প অথবা সাহিত্যকর্মের মাঝে স্বকীয় স্বাক্ষর স্থাপন না করতে পারলে সাহিত্যজগতে তার স্বতন্ত্র পরিচয় নির্মিত হতে পারে না। বস্তুত একজন লেখকের রচনায় তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নির্মাণ না করতে পারলে সাহিত্যকর্মটি একটি প্রতিলিপি হিসাবেই গণ্য হবে। শুধুমাত্র বানান ও ব্যাকরণ মেনে লিখলেই যে লেখাটি সুপাঠ্য এবং সাহিত্যগুণ ও মানসম্পন্ন হয়ে উঠবে এর কোন নিশ্চয়তা নেই। 
সাহিত্যে শ্লীলতা ও অশ্লীলতার প্রশ্ন নিয়ে বহুকালের বিতর্কও আজও চলছে। সাহিত্যের বিষয়বস্তু কিংবা অবয়বে নৈতিক প্রসঙ্গের সরল, একমুখী ও সুনির্দিষ্ট অবস্থান থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। কেননা বিশ্বাসী লেখকরা মনে করেন জীবনের জয়গান করা, মানুষের মহত্ত্ব উদযাপন, অশুভর সাথে সংঘাত শেষে শুভর বিজয় দেখানো, জীবনকে ইতিবাচক আলোয় দেখা শিল্প-সাহিত্যচর্চার অন্যতম লক্ষ্য।   
সাহিত্যে বাস্তবতার বিষয়টি বিপুল অর্থবোধক। বাস্তবতার নিরিখে নৈতিক-অনৈতিক বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে সাহিত্য চর্চা করলে তা কতটা স্থায়ীত্ব লাভ করে সেটাও বিবেচ্য বিষয়। ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের সাদা-কালো ভাগের মধ্যিখানেও জীবনের অনেক ধূসর অঞ্চলকে তুলে আনার একটা অন্তর্গত তাগিদ সাহিত্যের ভেতরে থাকে। তাই, নৈতিকতার অনড় মানদণ্ড মাথায় নিয়ে সাহিত্য চর্চা ইতিবাচক অবস্থানই তৈরি করে বৈকি। তবে এ ক্ষেত্রে নান্দনিকতার বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। ধর্ম যেমন সিদ্ধ ও নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ তোলে, সাহিত্যের কাজ পুরোপুরিভাবে তেমন না হলেও নান্দনিকতাকে বুকে ধারণ করে নিষিদ্ধ-সিদ্ধের বিবেচনায় এগিয়ে যাওয়াও একজন দায়বদ্ধ লেখকের অন্যতম অঙ্গীকার।
যদিও এরিস্টোটল তার ‘পোয়েটিক্স’ গ্রন্থে  ‘নৈতিক’ ও ‘নান্দনিক’ এর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। যা কিছু নৈতিক ও যৌক্তিক তা সর্বদাই মানুষকে নান্দনিক তৃপ্তি দিবে, এমন নয়। অন্যদিকে কীটসের ইবধঁঃু রং ঃৎঁঃয, ঃৎঁঃয নবধঁঃু উক্তিটিতে তাঁর নন্দনভাবনার সার রয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। এই উক্তি নিয়ে কারো কারো দ্বিমত থাকলেও একথা বাস্তব যে ‘সত্য তিক্ত’ হলেও সুন্দর। কীটস এখানে এক শিল্পতত্ত্বের ইশারা দিচ্ছেন, যা সূক্ষ্মবিচারে অনেকটা অ্যারিস্টোটোলীয়। কীটস এখানে শিল্পের জগতে নির্মিত সত্য ও সুন্দরের কথা বলছেন। বাস্তবতাকে  শিল্পী এমনভাবে নির্মাণ করবেন যা ভাবগতভাবে ‘পাঠক’-এর  কাছে সত্য বলে প্রতীয়মান হবে। পাঠক যেনো ধোকা না খায়, সে বিষয়টিকেও মাথায় রাখবেন লেখক। 
লেখকগণ নতুন নন্দন সৃষ্টি করতে পারেন না। একজন দক্ষ কারিগড়ের মতো কোন একটা সামান্য বস্তু থেকে অসাধারণ কিছু তৈরি করেন। তখন পুরোনো নন্দনসূত্র দিয়ে তাকে আর ধরা যায় না। সাহিত্যের ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয়। রবীন্দ্রনাথের নন্দনভাবনা দিয়ে জীবনানন্দ দাশকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। নজরুলের নান্দনিকতা জীবনের জীবনের নিবিড় বাস্তবতা ছুঁয়ে গেলেও মাইকেল মধুসুদনের নান্দনিকতা সে রকম নয়। ফররুখ আহমদ কিংবা  জসীমউদ্দীনের নন্দনতত্ত্ব যেমন ভিন্ন তেমনি মূল্যবোধের দৃষ্টিভংগিও আলাদা হতে পারে। তবে নান্দনিকতা ও মূল্যবোধের যৌথ ছোঁয়ায় সৃষ্টিকর্ম স্থায়িত্ব লাভ করে বেশি।
সাহিত্য জগতের একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। যে নিয়ম ভাষা, অলঙ্কার ও বিষয়বস্তু প্রকাশের সুদীর্ঘ অনুশীলনের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত। যেটা রক্তমাংসের মনুষ্যসমাজের কার্যকারণ নীতির প্রতিফলন যেমন হতে পারে, তেমনি হতে পারে তার বিনির্মাণও। মনকে সাদা পাতার মতো করে সাহিত্য করলে তা নিরামিশ সাহিত্য হতে পারে। ব্যক্তির ইতিহাসবোধ, জীবন অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধকে ধারণ করলে সৃষ্টিকর্ম মানব মনে সহজে আসন গেড়ে বসতে সক্ষম হয়।
রঙিন মন নিয়েই বেড়ে ওঠে শিশুরা। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কালোসহ বিভিন্ন রঙ সামনে থাকলেও লালের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ে তারা। সময় বাড়ার সাথে সাথে রঙ ধরে স্বপ্নগুলোতেও। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান দেখে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ নানা পেশার সফল মানুষদের দেখে। দাদু-নানুর গল্পকথায় কিংবা বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে তারা স্বপ্নের খোরাক সংগ্রহ করে। নিজেকে সাজিয়ে নিতে চায় একজন স্বপ্নের ডালিম কুমার কিংবা বিজয়ী সিন্দবাদ অথবা সালাহউদ্দিন আইউবী’র মতো। সময়ের ডানায় ভর করে বিশ্বায়ন তাদের হাতের মুঠোয়। ফলে এখন তারা গল্পকথা কিংবা বইয়ের পাতার চেয়ে বেশি ঝুঁকে পড়েছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন এবং এ সবের ভেতরের বিষয় অর্থাৎ ইন্টারনেট বলয় কিংবা গেমস-কার্টুনের সংস্পর্শে। ফলে তাদের রঙিন স্বপ্ন্গুলো ক্রমশ নেটময় হয়ে কৃত্রিমতার মোড়কে আবর্তিত হচ্ছে। তাই অনেকেই আবার গল্পকথার দিকে ফিরে যাবার গুরুত্ব অনুভব করছেন। কিন্তু দাদু-নানুর সময় কোথায় গল্প শোনাবার? কিংবা দাদু-নানুকে কাছেই বা পাবে কেমনে? অথবা দাদু-নানুরাও কি আগের মতো গল্প বলতে পারেন? নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে অবশেষে শিশুসাহিত্যই একমাত্র ভরসা। তাইতো শিশুসাহিত্যকেই এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। আর নেটপাগল শিশুদের আকর্ষণ করে মূল্যবোধের সংস্পর্শে আনতে হলে শিশুসাহিত্যকে নির্মাণ করতে হবে মূল্যবোধের সবুজ মলাটে নান্দনিক এবং আকর্ষণীয় ঢঙে।
শিশুরাই মানবিক সংস্কৃতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাদের হৃদয় বাগানে কোমলতার ফুলকলি হেসে ওঠে সব সময়। তাইতো তাদের আধোবোলের প্রথম শব্দ থেকে শুরু করে প্রতিটি কথাই হয়ে ওঠে মজাদার। বাবা-মা কিংবা পরিবারের সদস্যরা তার প্রতিটি আচরণে বিস্ময় খুঁজে পায়। নিজের শিশুর বেড়ে ওঠার গল্পটা অন্যের কাছে বলে ফেলেন সুযোগ পেলেই। হাঁটিহাঁটি পা পা করে স্কুলে যাওয়ার আগে থেকেই তাকে নিয়ে শুরু হয় হাজারো স্বপ্ন। অনেক বড় মানুষ করার স্বপ্ন দেখেন প্রত্যেক অবিভাবক। কথা ফোটার সাথে সাথেই সে শিখে ফেলেÑ ‘আমি ডাক্তাল হবো, ইন্দিনিয়াল হবো’ এ রকম অনেক কথা। শিক্ষা গ্রহণের বয়স হতে না হতেই তার হাতে তুলে দেয়া হয় নানা রঙের ছবি-ছড়ার বই। এ যাত্রা আর থেমে থাকেনা। স্কুলের বারান্দায় যেতেই এক ব্যাগ বই ঝুলিয়ে দেয়া হয় তার পিঠে। প্লে-নার্সারি থেকেই তাকে ইংরেজি আর সাধারণ জ্ঞানে পণ্ডিত বানানোর চেষ্টা চলে অবিরাম। ক্লাশটেস্টসহ প্রতিটি পরিক্ষায় একশোতে একশোই পেতে হবে। দুই-এক নাম্বার কম পেলেই মায়েদের ঘুম হারাম। শিশুটিকে ক্রমশ যন্ত্রের মতো ঘুরানো শুরু হয়ে যায়। স্কুল, হোমটিউটর এবং বাবা-মা মিলে ‘পড়ালেখা আর লেখাপড়া’ এর বাইরে আর কোন বিষয় নেই। যে টুকু সময় পায় তাতো মোবাইল, ল্যাপটপ কিংবা ট্যাবের গেমস খেলার মধ্যেই কেটে যায়। খেলাধুলা, গল্পশোনা কিংবা মজাদার সাহিত্য থেকে মানবিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ কোথায়? তবুও আমরা মানবিকতার স্বপ্ন দেখি। তাই অনেক অবিভাবক এ ব্যস্ততার ভিড়েও শিশুর হাতে তুলে দিতে চান শিশুসাহিত্য। খুঁজে ফেরেন নানা ধরনের মজাদার নান্দনিক এবং মূলোবোধের আবহে আকর্ষনীয় শিশুতোষ বই। কিন্তু বাজারে হাজারো শিশুতোষ বই থাকলেও কতগুলো বই আছে মানবিক মূল্যবোধ জেগে তোলার মতো? যে বইগুলো মূল্যবোধ শিখায় সেগুলোতে নান্দনিকতার পরশ নেই বললেই চলে। যেগুলো নান্দনিকতার মোড়কে উপস্থাপিত সেগুলোতে মূল্যবোধের ছোঁয়া নেই। তাই আজ বড় প্রয়োজন সমন্বয়ের। তাই আজ বড় প্রয়োজন নান্দনিক ও মূল্যবোধের শিশুসাহিত্য সৃষ্টির।
শিশুদের উপযোগী সাহিত্যই শিশুসাহিত্য। সাধারণত শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় রেখে এ সাহিত্য রচনা করা হয়। শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক অথচ মনোরঞ্জক গল্প, ছড়া, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদিকেই সাধারণভাবে শিশুসাহিত্য বলে। শিশুসাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর বিশেষ বক্তব্য, ভাষাগত সারল্য, চিত্র ও বর্ণের সমাবেশ, হরফের হেরফের প্রভৃতি কলাকৌশলগত আঙ্গিক। শিশুসাহিত্যের বিষয়বৈচিত্র্য অফুরন্ত। এতে থাকে কল্পনা ও রোম্যান্স, জ্ঞান-বুদ্ধির উপস্থাপনা, রূপকথা, এ্যাডভেঞ্চার আর ভূত-প্রেতের গল্প। বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিকদের রচনাসমূহের মধ্যে বিশেষত হ্যান্স এন্ডারসনের ফেয়ারি টেলস, এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড; ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রসো; জোনাথন সুইফটের গালিভারস ট্রাভেলস; সারভাস্টিজের ডন কুইকসোট, ট্রেজার আইল্যাান্ড, ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড প্রভৃতি যুগযুগ ধরে সব দেশের শিশুদের আনন্দ দিয়ে আসছে। বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্যের গোড়াপত্তন হয় ১৮১৮ সালে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘নীতিকথা’ নামক গ্রন্থের মাধ্যমে। উপদেশমূলক ১৮টি গল্পের সমন্বয়ে প্রণীত এ গ্রন্থটি স্কুলপাঠ্যরূপে ব্যবহৃত হলেও প্রকৃতপক্ষে এটিই  প্রথম শিশুপাঠ্য গ্রন্থ বলে বিবেচিত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, স্বর্ণকুমারী দেবী প্রমুখের রচনার মাধ্যমে শিশুসাহিত্যের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের বোধোদয়, কথামালা, চরিতাবলী, আখ্যানমঞ্জরী, বর্ণপরিচয়; অক্ষয়কুমারের চারুপাঠ; মদনমোহনের শিশুশিক্ষা এবং স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত বালক পত্রিকার উল্লেখ করা যায়।
শিশুসাহিত্যের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় রবীন্দ্রযুগে। রবীন্দ্রপূর্বযুগের শিশুসাহিত্য জ্ঞানমূলক, উপদেশমূলক ও নীতিকথামূলক ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রযুগের শিশুসাহিত্য মুখ্যত আনন্দমূলক। এ সময়ের হেমেন্দ্রপ্রসাদের আষাঢ়ে গল্প, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিরাশি, দক্ষিণারঞ্জনের ঠাকুরমার ঝুলি, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ভূত-পেতনী, উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির বই, সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরীর নূরনবী, হাবিবুর রহমানের হাসির গল্প, ইমদাদুল হকের কামারের কাণ্ড, ইব্রাহিম খাঁর ছেলেদের শাহনামা, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর সিন্দাবাদ সওদাগরের গল্প, বন্দে আলী মিয়ার চোর জামাই, মোহাম্মদ মোদাবেবরের হীরের ফুল, হবীবুল্লাহ বাহারের ওমর ফারুক, আবুল কালাম শামসুদ্দীনের কচিপাতা, কাজী নজরুল ইসলামের ঝিঙে ফুল ইত্যাদি গ্রন্থ শিশুসাহিত্যকে নৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও সমৃদ্ধ করেছে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য পত্র-পত্রিকার মধ্যে মুকুল, প্রকৃতি, সন্দেশ, মৌচাক, শিশু সাথী, খোকা খুকু, শুকতারা, টাপুর টুপুর ইত্যাদিও শিশুদের হাতে উঠে এসেছে শিশুসাহিত্যের আদলে। কবি গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, কাজী কাদের নেওয়াজ, ফররুখ আহমদ, মোহাম্মদ নাসির আলী, শওকত ওসমান, আতোয়ার রহমান, হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন, বেগম সুফিয়া কামাল, আশরাফ সিদ্দিকী, রোকনুজ্জামান খান, মাহবুব তালুকদার, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, মতিউর রহমান মল্লিক, গোলাম মোহাম্মদ, হুমায়ুন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ গদ্য ও পদ্যে শিশুতোষ সাহিত্য রচনা করেছেন। সাহিত্যের রসে সমৃদ্ধ হলেও অনেক লেখাতেই নৈতিক মূল্যবোধের সবক তুলনামূলক কমই চোখে পড়ে।
ইতোপূর্বে শিশুসাহিত্যের ধারায় ইসপের গল্পসহ নানা এডভেঞ্চারের বিষয়বস্তুই মূল ভূমিকায় থেকেছে। কখনো অনুবাদের ঢঙে আর কখনো বা বিদেশী গল্পের অনুকরণে সে সব সাহিত্য রচিত। বাংলাভাষার শিশুসাহিত্যের বেশীরভাগই অন্য ভাষায় প্রকাশিত বই থেকে অনুবাদ করে প্রকাশ হয়েছে। ক্লাসিক যেগুলো আছে সেগুলো মূলত মৌখিকভাবে প্রচলিত রূপকথা বা লোককাহিনীর লেখ্যরূপ। এ গল্পগুলো বিভিন্নভাবে শিশুর মনস্তত্ব গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রভাব ফেলছে। বেশিরভাগ রূপকথার গল্পেই থাকে রাজা এবং সুয়োরানী আর দুয়োরানী। একজন খুব খুব খুউব ভালো আর একজন খারাপ। মানুষকে ভালোভাবে চিনতে শেখার আগেই গল্পে গল্পে বাইরের দুনিয়া সমন্ধে শিশুরা খারাপ মানুষের ধারণাও পেয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে কতগুলো গল্পের মাঝে অমুককে শূলে চড়ানো হলো, মাথা কাটা পড়লো, নাক কাটা পড়লো, আগুনে পুড়িয়ে মরলো, ঘাড় মটকে খেলো, বাঘে খেলোÑ এরকম বর্ণনা আছে। আবার যেহেতু ভালো আর খারাপ পরিষ্কারভাবে আলাদা করে দেয়া হয়েছে, যে খারাপ, তাকে আর মানুষ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। কাজেই তাকে শাস্তি দেয়া ঠিক আছে। ভয়াবহ সব নির্যাতন বা পরিণতি নিয়েও তাই বিচলিত হবার কিছু নাই। কারণ সে তো আর মানুষ না। কাজেই যখন কোন একজন ভালো মানুষকেও কোনভাবে খারাপ মানুষের দলে ফেলে দিয়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করলেও তাতে কোন আফসোস থাকে না। বলা হয়ে থাকে যে, খারাপদের তো অমনই হয়। এ ধরনের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। তাই শিশুদের হাতে মানবিক সাহিত্যই বেশি প্রয়োজন নয়কি?
টোনাটুনির গল্পসহ এমন অনেক গল্পই শিশুসাহিত্যের জায়গা দখল করে আছে। টোনাটুনির গল্পে টোনা সবার থেকে সাহায্য নিয়ে উপকরণ জোগাড় করে। টুনি পিঠা বানায়। পিঠাগুলো এতোই মজার যে নিজেরাই সব খেয়ে ফেলে। এ পর্যন্ত গল্পটি ঠিকই ছিল, কিন্তু গল্পের শেষ অংশ কিংবা গল্পের মূলঅংশ আসে যেখানে সব সাহায্যকারীদের পিঠার ভাগ দেওয়ার হাত থেকে বাঁচতে টোনাটুনি অন্যখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকে আর বোকা বনে যাওয়া সাহায্যকারীদের নানাভাবে ভেংচি কাটতে থাকে। টোনা সবাইকে কথা দিল পিঠার ভাগ দিবে। এ গল্পের একটি বর্ণনায় পাচ্ছি, টোনা টুনি নিজেরা সব পিঠা খেয়ে ফেলার পর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকল, আর সবাই পিঠা খেতে এসে বোকা বনে ফেরত গেল। টোনা টুনি লুকিয়ে তা দেখে খুব মজা পেল আর ছড়া কাটল। অর্থাৎ কথা দিয়ে না রাখা কোন ব্যাপার না, ধরা না পড়লেই ফুর্তি। একই গল্পের আরেকটা বর্ণনায় পাচ্ছি, সব পিঠে খেয়ে ফেলার পর টোনা ময়লা অথবা মাটি দিয়ে পিঠের বানিয়ে রেখে দিল। বাঘ এসে সেটা হালুম হুলুম করে খেয়ে নিয়ে পরে টের পেল সে খারাপ বিস্বাদ জিনিস। এটা কোন খাবার না। তখন ক্ষেপে তর্জন গর্জন করলো। টোনা টুনি ফুরুত করে পালিয়ে গেল। সেই একই শিক্ষা, ভেজাল দাও, ফাঁকি দাও, ধরা না পরলেই তুমি বাহাদুর। তাহলে কেনই বা কেউ সততা সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা অবলম্বন করবে? একই শিক্ষা আছে কুমড়োতে করে গড়িয়ে চলা বুড়ির গল্পে, সবাইকে কথা দিয়ে পরে পালিয়ে বেড়ানোতেই বুড়ির ভারি বাহাদুরি।
বই মেলাতে শিশুকর্ণারের স্টলগুলোতে গেলে অনেকটা হতাশা নেমে আসে। ছয় থেকে দশ বছরের শিশুদের জন্য সাহিত্য বলতে সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানারকম ভূতের গল্প আর রূপকথার ঠাকুমার ঝুলি। বড়ো জোর ঈশপের গল্প নানারকম চেহারার সংকলনে। যে বয়সটাতে শিশুদের নৈতিকতাবোধ তৈরি হয় তখনই তাদের হাতে আমরা কি তুলে দিচ্ছি? তুলে দেওয়ার মতো উপকরণ কি আদৌ আছে? কাজেই তারা এ বয়সে হা করে টিভি দেখে। কেউবা মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা ট্যাব নিয়ে গেমস খেলে অথবা কার্টুন দেখে। এসবের গেমস কিংবা কার্টুনগুলোও কি বাবা মায়েরা খেয়াল করে দেখছি যে কি দেখছে আমাদের শিশুরা? এখানে শিশুদের উপযোগী কি আছে উপভোগ করার মতো? একজন শিশু জন্মায় একদম পরিষ্কার সাদা একটা মন-মস্তিষ্ক নিয়ে। ফিতরাতের সাদা মনে আমরা কত অসচেতনে হাবিজাবি দিয়ে ভরে ফেলে নষ্ট করে ফেলি। শিশুর শারিরিক গঠন কিংবা পরীক্ষার গ্রেড বাড়াতে আমরা যতটা উতলা শিশুর মনস্তত্ব গঠনে ঠিক ততোটাই উদাসীন। 
শিশু-কিশোর মনের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। শিশু-কিশোর মন প্রশ্ন করতে ভালোবাসে, নিত্য-নতুন প্রশ্নের জবাব খোঁজে। গোটা বিশ্বকে সে প্রশ্নের মাধ্যমে জানতে চায়-বুঝতে চায়। চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে তার আগ্রহ বেশি। শিশু-কিশোর মন এডভেঞ্চার প্রিয়। প্রকৃতির অজানা যেমন সাগর, মহাসাগর, পাহাড়, পর্বত, মহাকাশকে জানতে চায়, বিজ্ঞানকে জানতে চায়, নাটকীয়তা পছন্দ করে, উপস্থাপনার চমৎকারিত্ব পছন্দ করে, কাউকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পছন্দ করে। শিশু-কিশোর সাহিত্য নির্মাণে আমাদের এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। এক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে আদর্শিক ও মূল্যবোধভিত্তিক শিশু-কিশোর সাহিত্য যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। আদর্শিক ঘরানার শিশু-কিশোর সাহিত্যে নান্দনিকতা থাকলেও মানসম্মত বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখার মতো যথেষ্ট লেখক নেই। প্রকৃতির অজানাকে আকর্ষণীয়রূপে উপস্থাপনার ধারা এখনো তৈরী হয়নি। সাগর, মহাসাগর, পাহাড়-পর্বতের অজানা সৌন্দর্য ও চ্যালেঞ্জভিত্তিক লেখার এখনো যথেষ্ট অভাব। মুগ্ধহয়ে পড়ার মতো ভ্রমণকাহিনীর অভাব। ইতিহাসভিত্তিক গল্প, উপন্যাসের অভাব। অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বগণকে আজও এদেশের শিশু-কিশোরদের আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। শিশু-কিশোরকে সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্খায় উদ্বুদ্ধ করে এমন সাহিত্যের অভাব রয়েছে। শিশু-কিশোর সাহিত্যের এই অভাব পূরণে সম্মিলিতভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করার কোন বিকল্প নাই।
শিশু-কিশোরদের চিত্ত বিকাশের নির্দেশক হলো- প্রথমত, শিশু-কিশোর মনে এ ভাবনা জাগিয়ে দেয়া যে আমরা পৃথিবীতে এমনিতেই আসিনি, আমাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব তারই। আমরা তার প্রতিনিধি বা খলিফা। আল্লাহর দেয়া খেলাফতের দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অর্জন করা আমাদের দায়িত্ব। দ্বিতীয়ত, সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহ এবং তার আজ্ঞাবাহী পথনির্দেশক হিসেবে তার পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূলের প্রতি আনুগত্য পোষণের মধ্যদিয়েই প্রকৃত সফলতার পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তৃতীয়ত, তথ্যপ্রযুক্তির সমৃদ্ধির এ যুগে মানুষ ক্রমশ যান্ত্রিক জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। নিজেদেরকে মানবীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ করতে পারলেই প্রকৃত মানবিক সমাজ পাওয়া যাবে। এ লক্ষে প্রতিটি শিশুকেই স্ব-স্ব ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতি অনুগত ও ধর্মীয় বিধিবিধান পালনে অভ্যস্ত হওয়ার প্রতি উৎসাহ দেয় এমন সাহিত্য রচনা করতে হবে। সর্বোপরি, শিশুমনে যে বিষয়টিই উপস্থাপিত করার চেষ্টা করা হোক না কেন, তা  এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে শিশু-কিশোর সাহিত্যের ভিত্তি হতে হবে ধর্মীয় আদর্শ ও ঐতিহ্য। 
পরিশেষে বলা যায়, দক্ষ লেখকের সৃষ্টসাহিত্যে যা নৈতিক তা হয়ে উঠে নান্দনিক, আর যা নান্দনিক তাও নতুন অর্থে হয়ে ওঠে নৈতিক। এ জন্য এ সবের জন্য যোগ্যতা, দক্ষতা এবং চিন্তার পরিশ্রদ্ধতা একান্তভাবে জরুরী। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক অধ্যয়নের কোন বিকল্প নেই। লেখক যতো বেশি পড়বেন ততো বেশি নান্দনিকতাকে স্পর্শ করবেন। যতবেশি সমাজচিন্তা ও দায়বদ্ধতাকে আগলে নেবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে ততো বেশি মূল্যবোধের পরশ স্পর্শ করবে। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ অথবা গদ্য লেখায় একটা স্বচ্ছ, গতিশীল ও সাবলীল কাঠামো নির্মাণ না করতে পারলে লেখাটি সুপাঠ্য ও সাহিত্যগুণ সম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে না। শুধু রচনার গঠন কাঠামো অথবা গঠনশৈলী উন্নত করার জন্য নয়, বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করার জন্য যেমন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও দর্শনের বিষয়ে ভাল বইয়ের নিয়মিত পাঠ অভ্যাস গড়ে তোলা নবীন অথবা প্রবীন প্রতিটি লেখকের জন্যই খুবই জরুরী। অনেক লেখা চোখে পড়ে যেখানে তথ্য ও তত্ত্ব নিয়ে বিভ্রাট, অসম্পূর্ণতা, অজ্ঞানতা ও অপরিপক্কতার ছাপ উৎকটভাবে প্রকাশিত হতে দেখা যায়। তত্ত্বের ভিন্নমত অথবা সমালোচনা থাকতে পারে কিন্তু যে তথ্য ও তত্ত্বটি ঘিরে রচনাটি নির্মিত হয়, রচনার সামগ্রিক অভিব্যক্তিতে নির্দিষ্ট অথবা যাবতীয় তথ্য-তত্ত্বের স্বচ্ছ, সম্পূর্ণ, প্রাসঙ্গিক এবং সামগ্রিক রূপের প্রকাশ ও ব্যাখ্যা ফুটে উঠা বাঞ্ছনীয়। একটি অসম্পূর্ণ অথবা অসঙ্গতিপূর্ণ ক্যানভাসে ভারসাম্যের অভাব পাঠকের চেতনার নিবিড়ে প্রত্যয়ী এবং ফলপ্রসু যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হয় না। তাই নান্দনিকতা ও মূল্যবোধের সমন্বয়েই সাহিত্যের অবয়ব নির্মাণে আমাদের আরো বেশি আন্তরিক ভাবনা দরকার।

[লেখক: কবি ও গবেষক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।]

No comments

Powered by Blogger.