মনডুর লালপরী ।। মাহফুজুর রহমান আখন্দ
রোশনী। দশ-এগারো বছরের একটি মেয়ে। চোখেমুখে মায়াবী প্রলেপ। পরণে হালকা রঙের সালোয়ার-কামিজ। রঙ জ্বলে যাবার কারণে আরো বেশি হালকা লাগছে জামাটি। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দুএকটি অতিরিক্ত সেলাইও চোখে পড়লো। ছিঁড়ে যাওয়া জায়গাগুলো হাতের সূঁচেই সেলাই করে নিয়েছে। খুব খেয়াল না করলে চোখে পড়ে না। দক্ষ হাতের সেলাই বলেই মনে হলো। মাথায় হিজাব। ছেঁড়া ওড়না কেটে হিজাব বানানোর চেষ্টা করেছে। খুব সুন্দর না হলেও হিজাবী রোশনীকে ভালোই লাগছে। একজন মুসলিম কিশোরী হিসেবে মানিয়েছে বেশ। হিজাবের ছেঁড়া জায়গা দিয়ে খোপার অংশবিশেষ দেখা যায়। মাথায় চুল খুব বেশি নেই। চুলগুলো কিছুটা তামাটে। পার্লারে গিয়ে ফ্যাশন করে এমনটি করেনি। তেল-সেম্পুর অভাবেই তামাটে হয়েছে, তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
- স্যার, মালা লইবাননে, বকুল ফুলর মালা। স্যার ও স্যার।
চমকে উঠলাম আমি। আসলে এতোক্ষণ ওকেই পর্যবেক্ষণ করছিলাম গভীরভাবে। ‘ও হ্যাঁ, মালা? দাম কত?’
- দশ টিঁয়্যা স্যার। ফুঁইছন না স্যার, সুন্দর বাসনা।
সত্যিই ফুলগুলো বেশ টাটকা। গন্ধটা খুব মজার। মনটা ভরিয়ে দিলো নিমিষেই। বকুল ফুলের গন্ধ আমার ভীষণ পছন্দ। মালাতো কিনবোই। কিন্তু ওর সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছে হলো আমার। জানতে ইচ্ছে করলো ওর পরিচয়। কেনো যেনো মনে হলো সে আমাদের বাংলাদেশের মেয়ে না। আরাকানের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মেয়ে হবে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে গবেষণা করতে করতে ওদের বিষয়ে ভীষণ স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছি আমি। তাই কথা বাড়ানো চেষ্টা করলাম।
- কয়টা মালা আছে তোমার কাছে?
- স্যার দওশশো আছে স্যার।
- সবগুলো কতোটাকা নেবে?
- একশো টিঁয়্যা।
- একশো টাকা! সবগুলো নিলে দাম কম নেবে না?
- অনে খননা স্যার, কটিঁয়া দিবেন? চোখে-মুখে মায়াময় হাসির ঝিলিক।
বেশ খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে আমাদের সম্পর্কটা। আমি মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম। ‘কয়টা মালা নিয়ে এসেছিলে?’
- বিইশশোটা। দশশো ব্যাচা হয়ে গি।
- কোথায় বাড়ি তোমার?
- টেননাফত।
- টেকনাফের কোথায়? কোন জায়গার নাম না বলে শুধু ইশারা করে দেখালো।
আমার সন্দেহটা আরো বেশি ঘনিভূত হলো। ‘তোমার আব্বু কী করেন?’ বলতেই চোখদুটো কেমন নিচের দিকে নামিয়ে নিলো সে। তার চঞ্চলতাও নেমে এলো শূণ্যের কোটায়। বুঝতে আর বাকী থাকলো না যে ওর বাবা নেই। নিজেকে বেশ অপরাধীই মনে হলো। কেন ওর কষ্টটা বাড়িয়ে দিলাম? কিন্তু ভেতরে ভেতরে আগ্রহটা আরো বেশি তীব্র হলো ওকে জানার। তাই আবারো জিজ্ঞেস করলাম, তোমার আব্বু কবে মারা গেছেন?
কোন কথা বলতে চাচ্ছে না সে। মনে হলো তার চোখে পানি জড়ো হতে শুরু করবে এখনই। আমি কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ফুলগুলো হাতে নিলাম। বললাম, একশো টাকাই দেবো? সে শুধু মাথা নাড়লো। পরিবেশটা হালকা করতে চাইলাম আমি। বললাম, যদি পাঁচশো টাকা দেই?
মানিব্যাগ থেকে নোটটা বের করে ওর সামনে তুলে ধরলাম।
পরিবেশ সামলে নিয়ে কিছুটা হাসির আভা ছড়িয়ে দিলো ঠোঁটের কোণায়। আমি হয়তো তার সাথে মশকরা করছি। তেমনটিই মনে হলো ওর চেহারা দেখে। তাই একটু দৃঢ়তার সাথেই বললাম। ‘হ্যাঁ, যদি তোমাকে পাঁচশো টাকা পুরোটাই দেই?’
- আয়ার ছোটবোনর লাই লাল জামা কিনিবাল্যায় ফুলর মালাগুন বেচিদ্দে স্যার। সামনে ঈদ।
- তোমার ছোটবোন আছে? কী নাম ওর?
- আচে স্যার। আরিফা। ছয় বছর। খুব দুষ্টু স্যার।
- লাল জামা খুব পছন্দ করে সে?
- মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। কিন্তু কি যেন বলতে গিয়ে আবার থেমে গেলো সে। আমি তাকে আবারো জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বাড়ি কি সত্যিই টেকনাফে?’
অনেক ক্ষণ চুপ করে থাকলো সে। তারপর হাতের ইশারায় নাফনদীর ওপারের দিকে ইঙ্গিত করলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আরাকানে? মাথা নাড়লো সে। আরাকানের কোন এলাকায়?
- মনডু, বর্মার মগরা আঁয়ার বাফোরে মারি ফালাইয়্যে। দঁড ভাইরেও মারি ফালাইয়্যে। মগে আঁয়ার গরবারি জ্বালাইপুরাই দিয়্যেই। আঁই, আঁয়ার ছোঁডবোন আর মা বর্মত থোন টেননাফত দাই আইগিয়ই।
চোখের কোণায় আবারো পানি জমে এসেছে। কণ্ঠও ভারি হয়ে এসেছে তার।
- এখানে কোথায় এসে উঠেছো?
- আঁয়ার মামাও টেননাফত দাই আইগিয়ই।
- কি হয়েছিল ওখানে?
সে আরো জানায়, মগরা তাদেরকে ঘর থেকে বের হতে দেয় না। শুধু মারে। তাদের বাড়িঘর পুড়ে দিয়েছে। বেশিকিছু বলতে পারে না সে। নির্যাতনের ভয়াবহতার কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারে না। শুধু লাশ আর বাড়িঘর পোড়ানোর কথাটি বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে থাকে। তবে তার কথার মধ্যদিয়ে সাজানো গোছানো বাড়িঘরের কথা বোঝা গেল। সুন্দর ছিমছাম টিনের বাড়ি ছিলো তাদের। বাড়ির চারপাশে নানা ফলের গাছে ভর্তি ছিল। জমিজমা যা ছিল তাই দিয়েই তাদের সারা বছরের খাবার হয়ে যেতো। তার বড়ভাই এবং বাবা মিলেই জমিতে চাষাবাদ করতো। বাড়ির পাশের মসজিদ সংলগ্ন মক্তবে পড়তো রোশনী। মাঝে-মধ্যে ওর ছোটবোন আরিফাও যেতো পড়তে।
রোশনীর বাবা খুব সৌখিন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। মেয়েদের খুব আদর করতেন। বিশেষকরে ছোটমেয়ে আরিফাকে। চোখের আড়াল হতে দেননি কখনো। যখন যা আবদার করেছে, তাই পূরণ করার চেষ্টা করতেন তিনি। সেবার ঈদে লাল জামা চেয়েছিল সে। বাবা কিনেও দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেলো। রাত দশটার দিকে পুলিশের সাথে মগেরা এসে ধরে নিয়ে যায় তার বাবাকে। পরের দিন লাশ পাওয়া যায় খালপাড়ের জঙ্গলের ভেতর। এ নিয়ে শুরু হয় গণ্ডগোল। রোশনীর ভাইসহ অনেককেই মেরে ফেলে ওরা। চাচাতো বোন সামিরাকে তুলে নিয়ে যায় বাড়ি থেকে। তাকে আর পাওয়া যায়নি। বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কেউ কেউ পুড়েই মারা যায়। পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে রোশনীরা তার মামার সাথে পালিয়ে আসে টেকনাফে। আসার সময় আটদিন নৌকার ভেতরে ভেসে ভেসে সময় পার করেছে। বিশুদ্ধ পানি আর খাবারের অভাবে অনেকেই মারা গেছে নৌকার ভেতরে। বাংলাদেশেও আশ্রয় নেয়া কঠিন। বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে রোশনীরা আশ্রয় নিয়েছে টেকনাফের নাইট্যাংপাড়া পাহাড়ি জঙ্গলের ঝুপড়িতে।
রোশনীর কথাগুলো স্বপ্নের মতো মনে হলো। চোখের সামনে সিনেমার মতো চিত্রায়িত অবস্থায় ভাসতে থাকলো দৃশ্যগুলো। কোন কথা বের হচ্ছেনা আমার মুখ থেকেও। এমন নিস্পাপ মেয়েটি যদি আমাদের কারো হতো? মায়ায় জড়িয়ে গেলাম ভীষণভাবে।
রোশনীর মাথায় হাত বুলিয়ে আরো পাঁচশো টাকা যুক্ত করে এক হাজার টাকা দিয়ে বললাম, তুমিও একটা লাল জামা কিনে নিও।
আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো রোশনী। হয়তো তার বাবার কথাই মনে পড়েছে। তার বাবার দেয়া লাল জামাটিই হয়তো সে অনুভব করছিলো তখন। ঈদের দিনে লালজামা পরা রোশনী আর আরিফার চেহারাটা ভাসতে থাকলো আমার চোখের মণিতে। নেচে নেচে উড়ে বেড়াচ্ছে দুটি আদুরে লালপরী। মনডুর লালপরী।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/samoiki
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801720070848
🔗 E-MAILL
samoikionline@gmail.com

No comments