কবিতা হবে অলঙ্কার বাহূল্য বর্জিত প্রিয়দর্শিনী ।। মুজতাহিদ ফারুকী

 
কবিতা ভাবনা
কবিতা হবে অলঙ্কার বাহূল্য বর্জিত প্রিয়দর্শিনী
মুজতাহিদ ফারুকী

কবিতা লেখা মোটেই সহজ না। একটি ভাবনার শৈল্পিক রূপায়ন বড্ড কঠিন। ভাবনার যেমন মানসম্মত হওয়া জরুরী, তেমনই জরুরী সেটিকে রসোত্তীর্ণ করে তোলাও। শুধু যে নির্ভুল ছন্দ ও বাক্য গঠনেই এ প্রকল্প সিদ্ধ হবে, এমনও না। তাই যদি হতো, নিশ্চিত রবীন্দ্রনাথ নন, সত্যেন্দ্রনাথ পেতেন সবচেয়ে বড়ো কবির সম্মান। নির্ঘাৎ। 

ভাবানুগ ঠিক ছন্দটি বেছে নেয়া, ভাব প্রকাশে যথাযথ শব্দের সুসমঞ্জস ব্যবহার এগুলো সার্থক কবিতার অপরিহার্য শর্ত। যেমন অলঙ্করণ। অলঙ্কার ছাড়া কবিতা? না, সম্ভব না। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, যমক, রূপকল্প থেকে শুরু করে কূটাভাষ, বিরোধাভাষ, বক্রোক্তি, ব্যাজস্তুতি এবং আরও নানা নমুনা পেরিয়ে স্বভাবালঙ্কার পর্যন্ত বহু বিচিত্র গহনার নকশা দিয়ে গেছেন বিশ্বের সর্বকালের কাব্যকলাবিশারদরা। সব অলঙ্কার একটি কবিতায় প্রয়োগের প্রশ্ন নেই। কবিতা জুয়েলারির বিজ্ঞাপনের মডেল না। সাম্প্রতিককালের একশ্রেণির ধনকুবের পরিবারের বউদের মতো হাজার ভরির জরোয়া গহনায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আবৃত করা বিত্ত-বেসাতের রুচিহীন উৎকট প্রদর্শনীও না কবিতা। কবিতা তবে কী? রুচিশীল স্বচ্ছল পরিবারের বিয়ের ক’নে বললে বোধ হয় বেমানান হয় না। আরও ভালো হয় যদি, হিন্দুদের বিদ্যাদেবীর প্রতীমা কল্পনা করি। বলতে চাই, কবিতা হবে অলঙ্কারবাহূল্যবর্জিত প্রিয়দর্শিনী। যাকে দেখে নয়ন শীতল, মন প্রফুল্ল হয়। সুরুচির আস্বাদন মেলে। এই সুরুচির প্রশ্নে আবার একটু থমকে দাঁড়াতে হবে। কবিতাকে সুরুচির পরিপোষণ করতেই হবে এমনও তো নয়। যদি হতো, তাহলে হাংরি জেনারেশনের কবিতা সবই বাতিল হয়ে যেতো। চরম অশ্লীল বলে কথিত মলয় রায় চৌধুরীর কিছু কবিতা আমার অসম্ভব ভালো লাগে। 

অলঙ্কার ব্যবহারে তাই পরিমিতি বাঞ্ছিত। শুধুই অলঙ্কার পরানোয়? না, কবিতা চায় আপাদমস্তক পরিমিতির চর্চা। পরিধেয় তো অতিঅবশ্যই, ম্যানিকিওর, পেডিকিওরসহ প্রসাধন থেকে বাচন, অঙ্গচালন এমনকি আচরণেও। কবিতার আবার আচরণ কি? আছে। এটি হলো ডেলিভারি। যে-কথা বলতে চাই সেটি কী মুডে বলছি। বিষয়ের সঙ্গে বাচনভঙ্গির, বচনচ্ছুরণের অন্বয় ঘটছে কি? ঘটলে ভালো। না ঘটলে শালীনতার সীমা পেরিয়ে গেল। কবিতায় বিদ্রোহের কথা ‘বিদ্রোহী’র মত করেই বলতে হয়, মহাত্মা গান্ধীর মত করে নয়।  

কথা এটুকু হলেও কথা ছিল না। কিন্তু কথা থেকে যায়। এজন্যে যে, একটি ভাবনার কবিতা হয়ে ওঠার অন্যবিধ শর্তও আছে। আঙ্গিক বা ফর্ম, অলঙ্করণ, নতুন বাগধারা তৈরি ও বাগভঙ্গি বা ভাষাভঙ্গির নির্মাণ এবং সর্বোপরি এই সমস্ত সৃজনকর্মের সিনক্রোনাইজেশন, যাকে বলতে পারা যায় সমন্বিত সমরূপতা দেয়া। বড়ো কঠিন কাজ। এতসব কিছুর পরও আরও বড়ো যে কাজটি থেকে যায় সেটি হলো কবিতার স্বতঃস্ফূর্ততা, সাবলীলতা। সাবলীল না হলে কিন্তু পুরোটাই বাতিলের খাতায়। কিন্তু এই-ই কি সব? না, সবটা বলা হলো না এখনও। কবিতায় এমন কিছু থাকতে হবে যা পাঠকের অভিজ্ঞতার বাইরের, যা তাকে চমকে দেবে, অভিভূত করবে, ভাবনা উস্কে দেবে, তার দিলখুশ করবে। একটি কবিতা এতসব শর্ত ঠিকঠাক পূরণ/পরিপালন করলেই বলা যেতে পারে, এটি রসোত্তীর্ণ কবিতা হলো।

এজন্যে যেমন দরকার কবির পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি, তেমনই দরকার অভিনিবেশ ও নিমজ্জন। সত্যিকারের ডুবুরি না হলে রত্নাকর ঢুঁড়ে কবিতার দীপ্তিমান মণিকাঞ্চন তুলে আনা অলীক কল্পনামাত্র। তবে ভালো ডুবুরি হলেই কাজটা সম্ভব এমনও মনে হয় না। এজন্যে সবচেয়ে বেশি যেটি দরকার তা হলো বিশ্ব দেখার এক প্রেমময় অন্তর্দৃষ্টি। একটি উদার, সহনশীল, স্বজাতির বেদনাবোধে আপ্লুত প্রেমিক হৃদয় ছাড়া বাগে¦বীর হৃদয়হরণ কীভাবে সম্ভব? যেখানে মানুষীর হৃদয় পটানোই দুরূহ! একটু শালীন ভাষায় বলি, কবিতাসুন্দরীর কাছে আত্মনিবেদনের শক্তি বা ভক্তি কবির কাব্যসিদ্ধির অবিকল্প উপকরণ।

কবিতার কথা ভাবলে একটি প্রশ্ন মনে জাগে। কবিতা কোথায় থাকে? এই যে, প্রতিদিন ফেসবুকে, দৈনিকের সাময়িকীর পাতায়, ম্যাগাজিনে কত হাজার হাজার কবিতা ছাপা হচ্ছে তার মধ্যে কয়টি প্রকৃত কবিতা? যদি বলা যেতো, হাজারে অন্তত ১০০টা কবিতা হয়, ভালো লাগতো। বাস্তবে সেটা নয়। কারণ, প্রায় সব কবিতাই বিবৃতিপ্রধান। বিবৃতি সব কবিতাতেই থাকে হয়তো। কিন্তু তার অতিরিক্ত যেটা থাকে সেটাই কবিতা। নাটোরের বনলতা সেনের কাছে আমি দুই দণ্ড শান্তি পেয়েছিলাম, এটি কি জীবনানন্দের ব্যক্তিগত বিবৃতি নয়? কিন্তু, কবিতার কবিতা হয়ে ওঠার যেসব শর্তের কথা উপরে বলেছি, বনলতা সেন সেসব পূরণ করে পুরো মাত্রায়। কবিতাটির দ্বিতীয় প্যারা থেকে শুরু করে শেষ চরণ পর্যন্ত খেয়াল করে পড়লে প্রমাণ পাবেন। এ জন্যেই এটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবিতা।

মাঝে মাঝে মনে হয়, কবিতা আকাশে থাকে। হ্যাঁ, কবিতা নাজিল হয় তো, ওহির মতোই! সেটি কবিকে পেড়ে আনতে হয় ধ্যানযোগে, চিত্ত ও চেতনার নিবিষ্ট অভিনিবেশে। যদিও কবিকে কেউ নবী বলে না। কারণ, কবির কাজ কখনও নবীর কাজ নয়। 

No comments

Powered by Blogger.