কবি সৃষ্টির খেলায় এক নিমগ্ন সাধক ।। নজরুল মোহাম্মদ

 
কবিতা ভাবনা
কবি সৃষ্টির খেলায় এক নিমগ্ন সাধক
নজরুল মোহাম্মদ 

প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ! প্রতিটি মুহূর্তই উপলব্ধি করি, অনুভব করি- সময়ের সাথে সাথে সেসব মুহূর্ত গুরুত্বহীন হয়, সুখের বদলে দুঃখে নামান্তরও হয়। মুহূর্তের যে নিবিড় আয়োজন তার শেষ নেই। প্রতিশ্রুতিহীন সময়ে সকল আয়োজনই সুন্দর- হোক তা আনন্দের, বিষাদের! সময়ের সাথে নিজের বোঝাপড়াটা কৃত্রিমও হতে পারে, স্বাভাবিকও হতে পারে। আত্মসমর্পণ কিংবা আত্মসম্পূর্ণতায় জীবন যে সামঞ্জস্য খুঁজে বেড়ায় তা জীবনের সাথে জীবনের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন নয় বরং নিজেকে চিনতে পারার, জানতে পারার প্রতিমুহূর্তের জীবনব্যাপী কাজ।

কবি তার যাপনে এক যাযাবর যে প্রতিটি মুহূর্তের অলিগলিতে হাঁটতে চায় প্রশ্নময় চোরাগোপ্তা আলো-আঁধারে! সবার কাছে যা সমানবোধ্য নয় কবির নির্মল আত্মায় তা মহার্ঘ হয়েও উঠতে পারে আর সেসব মুহূর্ত কবি তার শব্দে আটকে ফেলে- সেসব শব্দ যে বাক্যে বিচরণ করে তা হয়তো কোন তত্ত্বের খোপে আটকে রাখা যায় না, প্রতিনিয়তই ভাঙা-গড়ার তত্ত্বেব নতুন ডিকশন রচিত হয়। অনেককিছুই অনেকের কাছে ভাস্কর্যের হিব্রু বা ল্যাটিন ভাষার মতো অর্থহীন হতে পারে, পোস্টস্ট্রাকচারালিজম কিংবা পোস্টমডার্নিজমের হাওয়া কবিতার গায়ে লাগতে পারে- এতে বিচলিত হবার কিছু নেই। সরল ও একরৈখিকতাতে কবি যদি তার মনোভাব প্রকাশ করে আনন্দ পান তাতে ক্ষতি নেই। জটিল ভাষ্য যেমন সবার জন্য বোধগম্য নয় তেমনি অনেক সরলও অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। সহজ কথা তো সহজ ভাবে অনেক সময় বলাও যায় না।

কবিতা বাস্তবতা ও কাল্পনিক চিত্রকল্পের এক সেতুবন্ধ। সমবোধের পাঠকের কাছেই কেবল তা আনন্দের পাঠ। কবির আরাধ্যজনই তাঁরা- তাঁদের পাঠ ধরেই কবিতা সমকালের সূত্র ধরেই মহাকালের যাত্রা শুরু হয়। কবি কবিতা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়- সৃষ্টির খেলায় সে এক নিমগ্ন সাধক।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অনিলের পুতুল’ পড়তে গিয়ে উৎসর্গ পত্রে চোখ আটকে গিয়েছিলো। সেখানে লেখা ছিলো- ‘অসুখ, দুঃসময় মানুষের ছবি তুলে ধরে। সেই ছবি দেখে বইটি লেখা। যখন লিখতে জানতাম।’ এই যে উপলব্ধি, এই যে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সে সমেত অক্ষরে নিজেকে মেলে ধরা এটা কালজয়ী লেখকদের ঐশ্বরিক ক্ষমতা। মাঝেমধ্যে মনেহয় কিছুই লিখতে পারছি না যা লিখতে চাই- এই অতৃপ্তিই হয়তো কলমকে সচল রাখে, কবি বা লেখককে দেয় অনেকের মাঝে একার সন্ন্যাস। সেই সন্ন্যাসী অক্ষর, শব্দ, বোধ ও অনুভবে সৃষ্টি করে মোহনীয় সুগন্ধি যার সুঘ্রাণ সৃজনশীল মানুষ বহুদূর থেকে পায়। সময়টা এখন এমন যে, মানুষ তার প্রয়োজনের অধিক মূল্যায়ন আপনাকে করবে না- এটা ভেবেই এই সমাজে আপনাকে চলতে হবে। নিজের কবিতা নিয়ে কিছু না-বলে জীবনানন্দের ‘সমারূঢ়’ কবিতাটি দিয়ে শেষ করলাম। 

‘বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা-’
বলিলাম মøান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিলো না উত্তর;
বুঝিলাম সে তো কবি নয়- সে যে আরূঢ় ভণিতা:
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ’পর
ব’সে আছে সিংহাসনে- কবি নযয়- অজর, অক্ষর
অধ্যাপক; দাঁত নেই- চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি;
বেতন হাজার টাকা মাসে- আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি;
যদিও সে-সব কবি ক্ষধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিলো- হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি।’

No comments

Powered by Blogger.