সমাজের পরিবর্তনের সবটুকুই প্রায় শিল্প-সাহিত্যে ধরা দেয় ।। আসাদ চৌধুরী
হাসান হাফিজ : বলা হয়ে থাকে, বাংলা সাহিত্যের রাজধানী হবে ঢাকা। এই বক্তব্যের সারবত্তা কতখানি? আপনার অভিমত কী এ ব্যাপারে?
আসাদ চৌধুরী : সম্ভবত ঢাকা ডাইজেস্ট পত্রিকায় ’৭৪-’৭৫ এ বলেছিলাম, ঢাকা বাংলা ভাষার রাজধানী। আমি এখনো পাথরের মতোই নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু। কেন না? দ্বিজাতিত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান হয়েছিল, রাজনীতিবিদরা তার সুযোগ ও ফায়দা নিয়েছেন। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে একটা জাতি ধীরে ধীরে সচেতন হয়েছে। নিজের সংস্কৃতি, ঐশ্বর্য, অতীত ও পরম্পরাকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছিল এবং ভাষাই ঠিকানা নির্দিষ্ট করে দেয়, যার জন্য এত ত্যাগ-তিতিক্ষা। আমার আশঙ্কা, ইতিহাস বিবেচনার ক্ষেত্রে আমাদের একগুঁয়েমি ও বাস্তবকে অস্বীকার করার প্রবণতা, মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার ব্যাপারে ভাষা আন্দোলনে অনুঘটকের কাজ করেছিল এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ও কংগ্রেস- স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পরবর্তী সময়েও দেখি ঐশ্বর্যের চমকের মধ্যে দেখি রাজনীতি-অনুঘটক এখন ধর্ম। আমাদের এফএম ব্যান্ড শুনলেই টের পাওয়া যায়, এতিম বাংলা ভাষার অভিভাবকরা কেমন দায়িত্বহীন। একটু মনে করিয়ে দিই, মমতাজুর রহমান স্যার একবার বলেছিলেন, এই মধ্যবিত্তের ভাষা আন্দোলন তো স্বাধীনতাযুদ্ধ কোনোটাই করার যোগ্যতা নেই, সেই মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে যত্ন ও শ্রম দিতে হয়, তাও তার নেই। তবুও হবে না, বাংলা ভাষার রাজধানী তো ঢাকাই।
হাসান হাফিজ : কবিতা ও গানের মধ্যে একসময় ভালো নৈকট্য ছিল। এখন মনে হয় দূরত্ব বেড়েছে। এ ব্যাপারে আপনার ধারণা ও অভিমত জানতে চাই।
আসাদ চৌধুরী : স্বতন্ত্র প্রবন্ধ লিখতে হবে এর জবাব দিতে হলে। শুধুু এইটুকু বলি, সমাজের পরিবর্তনের সবটুকুই প্রায় শিল্প-সাহিত্যে ধরা দেয়। কবিতা ও গান এ থেকে বাদ যাবে- ভাবা যায়? বব ডিলানের নোবেল পুরস্কার নিয়ে মেলা কথাবার্তা হয়েছে, হচ্ছে- তার নিষ্পৃহতার কথাও মনে হতে পারে। পশ্চিমের কোনো কোনো গানের ঢঙে যদি কবিতা পাঠের ভঙ্গি এসে যাচ্ছে, আমাদের দেশেও হচ্ছে। নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো হচ্ছেই। দেখা যাক না, কী হয়।
নাসির মাহমুদ : আপনি প্যালেস্টাইন এবং প্রতিবাদী দেশের প্রতিবাদী কবিতার সম্পাদনা করেছেন; তো বাংলাদেশে বোধহয় এই ধরণের কাজ এটাই প্রথম হয়েছে এর আগে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই- তো হঠাৎ করে এই কাজে উদ্বুদ্ধ হলেন?
কবি আসাদ চৌধুরী : প্রথমে আমি বলে নেই- হ্যাঁ, প্যালেস্টাইন বিষয়ক বা প্রতিবাদী দেশের প্রতিবাদী কবিতার কাজ এটাই প্রথম, এর আগে আর এ ধরনের কাজ হয়নি। তবে কবিতা ছাপা হয়েছে, অনেকে এ বিষয়ক অনুবাদও করেছে।
এটা বলতে গেলে যাদের কাছে আমাদের চিন্তাটা ঋণী, ভাবনা ঋণী তাদের সম্পর্কে বাজে কথা বলতে হয়। আজকে প্যালেস্টাইন, আফগানিস্তান এবং ইরাকের দিকে তাকালে পৃথিবীকে সভ্য কোনো জায়গা বলে মনে হয়! আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড তাদের লেখা পড়ে তাদের দার্শনিকদের ভাবনা চিন্তা পড়ে আমরা বড় হয়েছি, বলতে পারেন যে বুড়ো হয়েছি। কিন্তু বুড়ো হয়ে কি দেখছি যে এখানে নির্মমভাবে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, হাসপাতাল পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, জাদুঘর লুট হচ্ছে সেখান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে, নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করা যাচ্ছে- বিষয়টি যেন জাস্ট সিনেমা দেখছি, কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এদের কি বিবেক বলে কিছু আছে? তাহলে শিক্ষার অর্থ কি এই দুষ্কৃতিকারীদেরকে মেনে নেয়া। আমার খুব বিস্ময় লাগে এসব দেখে; আমি কোনোভাবেই এটা মানতে পারছি না। আমি পৃথিবীকে এখন জীবনানন্দের ভাষায় বলবো ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’ জীবনানন্দ দাস গভীরতর বলেছেন আমাকে বলতে হবে গভীরতম অসুখ।
জাহেদ সরওয়ার : যে পরিমাণ ইংরেজি শিখছি আমরা সেই পরিমাণ উপমহাদেশের ভাষাগুলো শিখছি না। এটা এই কারণেও হতে পারে যে, আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েছি। পাকিস্তানের ভাষা উর্দু এই জন্য? কিন্তু উর্দুভাষার যে শক্তিশালী লেখাজোকা। উর্দুকেন্দ্রীক যে সুফি সাহিত্য বা বিভিন্ন লিটারারি ডাইমেনশন। তা থেকে তো আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
আসাদ চৌধুরী : উর্দু সাহিত্য আমাদের এখানে বিকশিত হয়েছিল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমল থেকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলা দখল করল এর পরই একটু একটু উর্দু চর্চা কমতে লাগল। জাহাঙ্গীরনগর থেকে কিন্তু অনেক আগেই মুর্শিদাবাদ চলে গিয়েছিল রাজধানী। সেটা মুর্শিদকুলি খানের আমলে। তারপর রাজধানী যখন কলকাতা হলো ১৯০৫ পর্যন্ত অলইন্ডিয়া রাজধানী তো কলকাতাই ছিল। এর পরও কিন্তু ঢাকাতে উর্দু সাহিত্যের চর্চা ছিল। পাকিস্তান আমলে তারা বাড়াবাড়ি করায় উর্দুর উপর একটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ তো আরোপিত হলোই। আন্দালিব শার্দানির মতো কবি চলে আসছিলেন। রেজা আলি বারসাতের মতো কবি চলে আসছিলেন। নওশাদ নূরির মতো কবি চলে আসছিলেন এই ঢাকাতে। আতাউর রহমান জেমিল চলে এসেছিলেন। কাজেই এখানে উর্দু সাহিত্য চর্চা বিকশিত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। আসলাম উদাসের একটা বই ১৯৬৫ সালে বেরোয়। ঢাকা থেকে বেরোয়। নিশ্চয়ই মাগরিবে পাকিস্তান বা মাশরিকে পাকিস্তান লেখার কথা ছিল লিখছে বাংলাদেশকি মশহুর শায়ের। ’৬৫তে বাংলাদেশি মশহুর শায়ের বলাটা উর্দু বইতে এতো সহজ ছিল না। এদের মধ্যে সেই চেতনাবোধটা ছিল। কিন্তু যে কথাটা আপনি বললেন, ফয়েজ আহমদ ফয়েজের রুশ অনুবাদক যিনি। তার একটা লেখা কিছুদিন আগে আমার পড়ার সুযোগ হলো। সেখানে তিনি বললেন। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ বলেছিলেন যে, উর্দু মুসলমানের ভাষা না। উর্দু ভারতেরও বড় ভাষা। কিন্তু অনেকেরই ধারণা যে উর্দু মুসলমানদের ভাষা। যেমন একটা বইয়ের কথা বলি যেটার নখ থেকে চুল পর্যন্ত আগাগোড়াই আমার প্রিয়, শঙ্খ ঘোষ ও আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পাদিত সপ্তসিন্ধু ও দশদিগন্ত।সেখানে কিন্তু ইরানের বা আরবের কোনো কবিতা নেই।
মাজহার সরকার : আপনার প্রথম কবিতাবই ‘তবক দেওয়া পান’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। পানের কথা কীভাবে এলো আপনার কবিতায়? তখনও কি আপনি পান খেতেন?
আসাদ চৌধুরী : তখন আমি বিয়ে-বাড়িতে পান খেতাম। বইয়ের নামের বেলায় আমি চাচ্ছিলাম এমনকিছু একটা যা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান প্রতিটি বাঙালির কাছে প্রিয়। তো বাঙালির কাছে প্রিয় হচ্ছে-দুধ, মাছ আর পান-সুপারি। বিয়ে-বাড়িতে এ তিনটা জিনিসই দেখলাম। ‘সব খাওয়ালো পান দিল না- তামাক দিল না-’, এমন কথা হতো। পান হলো সমাদরের চিত্র। বাঙালির মাঙ্গলিক উৎসবে-আনন্দে পানের কদর আছে। গরিব আর বড়লোক সবাই কিন্তু সমাদর করতে ভালোবাসে। পানের মর্যাদা এতটাই। তো শুধু পান তো আর রাখা যায় না, তাই ‘তবক দেওয়া পান’ রাখলাম বইয়ের নাম।
সমকাল : আপনি সবসময় কাঁচা চুলওয়ালা তরুণদের ঘিরে স্বপ্নের কথা বলেন। মেধাবীরা রাজনীতিতে না এলে পরিণতি কী হতে পারে?
আসাদ চৌধুরী : বাংলাদেশে রাজনীতিতে মাস্তানরা ঢুকেছে এবং তারাই জোর করে ক্ষমতা নিয়ে নিচ্ছে। এটাকে ছিনতাই বলা যায়। রাজনীতি যদি আরেকটু সুস্থ হয়; গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসে তাহলে মেধাবীরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন। বাংলাদেশে একটি সমস্যা হলো, শিক্ষিত মানুষ বিদেশে চলে যাওয়ার চিন্তা করে। এখানে অধিকাংশ যুবক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় ভোগে। তরুণদের চোখে স্বপ্ন থাকতে হবে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রয়াস এখানে পুরোপুরি অনুপস্থিত। দলের প্রধান ছাত্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করায় ছাত্র রাজনীতি স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে পারছে না- এটা আমার মনে হয়েছে।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/samoiki
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801720070848
🔗 E-MAILL
samoikionline@gmail.com

No comments