তবক দেওয়া পান ।। আসাদ চৌধুরী
আমার পান খাওয়া শুরু সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে। যত দূর সম্ভব ১৯৯৬ সাল সেটা। আমার হাঁপানি আছে। সিগারেটের প্রতিটি পাফে কিন্তু কষ্ট হয়।
পানে এই কষ্টটা হয় না-তাই ধরে ফেললাম। তবে অন্য দিক থেকে সিগারেটের চেয়ে পান বেশি ক্ষতিকর। পানের ব্যাপারে আমার এমনিতেও কৌতূহল ছিল-ভিজানো সুপারি, কাঁচা সুপারি খেলে একেবারে কানটান গরম হয়ে যায়। আমার কাছে বিস্ময় লাগে যে কোথায় পান, কোথায় সুপারি, কোথায় চুন আর কোথায় খয়ের-সব মিলিয়ে বেশ আর্টিস্টিক ব্যাপারটি।
তবক দেওয়া পান
‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যগ্রন্থটি বেরিয়েছিল ১৯৭৫ সালে। বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-সবার অনুষ্ঠানে পানের ব্যবহার আছে। গ্রামাঞ্চলে এখনো অতিথি এলে পান দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। পানটা আবার মাঙ্গলিক।
পান বা দুধ, দুগ্ধজাত জিনিসপত্র, ধান, দূর্বা, কয়েন, মাছ-এগুলো এখনো বাঙালির কাছে মাঙ্গলিক চিহ্ন। এ রকমভাবে হঠাৎই ‘তবক দেওয়া পান’ মাথায় এলো। শেষ পর্যন্ত দিয়েও দিলাম। তবক দেওয়া পান কথাগুলো সফিসটিকেট মনে হয়। আমার একটা কবিতার অংশ ছিল ‘রূপালি তবক দেওয়া পান, রূপালি তবক দিয়ে পান নিয়ে বসে আছি তিন দিন...
‘কিন্তু মজার বিষয়, তখনো আমি পান খাই না। মাঝেমধ্যে বিয়েবাড়িতে খেতাম-এই যা।
পান ছাড়া দুদিন
সেই যে ‘৯৬ সালের দিকে পান ধরলাম, এরপর আমি পান ছাড়া মোটে দুদিন ছিলাম। সেটা মিসরের কায়রোতে। খুব যত্ন করে, এয়ারটাইট করে পান নিয়েছিলাম। ২১ দিনের মতো রেখেছিলাম। কিন্তুশেষের দিকে এসে দ্রুতই নষ্ট হয়ে গেল। তখন শুধু সুপারি আর জর্দা খেয়েছি। আমার মনে হয় গ্রামে যে কলাপাতা দিয়ে মুড়ে রাখে পান, তাতে মচমচে ভাবটা অনেক সময় থাকে। আমার সে সুযোগ ছিল না। আমি অবশ্য এয়ারটাইট বক্সে করে ফ্রিজে রেখে দিই, দু-তিন দিন পর্যন্ত থাকে। যা হোক, কায়রো থেকে ফেরার পর ঢাকায় এসে প্রথম যেটা খেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে এক খিলি পান। বাসা থেকে নিয়ে গিয়েছিল। বলে দিয়েছিলাম যে পান নিয়ে যেন এয়ারপোর্টে যায়।
আহা রে! তবক খাওয়া হলো না
ভারতে বিচিত্র ধরনের পান পাওয়া যায়। আমি অনেক রঙের পান দেখেছি; কিন্তু নরমালি পান হচ্ছে সবুজ পাতা। পান সাধারণত দুই স্টাইলে মোড়ানো হয়। বরফি স্টাইলে একটা, আরেকটা শিঙাড়ার স্টাইলে করে। বিয়েবাড়িতে বরকে যেটা দেওয়া হয়, সেটা বরফি স্টাইল। রূপার সঙ্গে হলুদ পিরিচে দেয়। দেখতে ভালো লাগে, খেতেও নিশ্চয়ই। শিঙাড়ার স্টাইলে বোঁটাটা থাকে না।
আমি অবশ্য অরিজিনাল তবক খাইনি কখনো। আমার নানুকে খেতে দেখেছি। অনেক দাম। আমার মেয়ে জামাই একবার নিয়ে এসেছিল, সেগুলো মনে হয় সিনথেটিক-জাতীয় তবক। ওগুলো এখনো কখনো-সখনো সন্দেশের ওপর কেটে কেটে দেয়। তো ওগুলো অরিজিনাল রূপার না। আমার নানুর কাছে যেটা ছিল সেটা রূপা এবং সোনার অরিজিনাল তবক। দেখেছি-বিয়েতে তিনি জামাইকে মুড়ে দিতেন।
দ্যাখো পানের বাহার
শুরুতে আমি পানের সঙ্গে মৌরি খেতাম। সুপারি, চুন, খয়ের তো আছেই, সঙ্গে মৌরি খেতাম। পরে হঠাৎ করে চমন বাহার কিনে ফেললাম। এটা ভারতীয় একটা মসলা। এরপর আমেরিকা গিয়ে পানে দারুচিনি ব্যবহার করলাম। খুব ভালো লাগল। তখন আবার দারুচিনি, লবঙ্গ, বড় এলাচ-এগুলো দিয়ে পান খেতাম। বড় এলাচটা খাই না এখন, দারুচিনিটা খাই; তাও বেশি না, কম। অবশ্য দেশি দারুচিনি নয়, এটা বাইরের-লম্বা লম্বা দারুচিনি। সম্ভবত শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া-এসব জায়গায় হয়। আমার বউমা, কখনো মেয়ে, কখনো কখনো শ্যালিকারা পাঠায়। এরপর আবার জাফরান দিয়ে খাওয়া শিখলাম, কে দিয়েছিল আজ আর মনে নেই। খেয়ে ভালোই লেগেছিল, এখনো মেজাজ থাকলে মাঝেমধ্যে জাফরান দিয়ে পান খাই। সাধারণত জাঁকজমক টাইপের মসলা দিয়ে পান খাই না, ওগুলো অ্যাভয়েড করি। আমি প্রধানত রাজশাহীর পান খাই। রাজশাহীর পান মচমচ করে, খেতেও সুস্বাদু। কিন্তু সাতক্ষীরার সাথি পানও ভালো লাগে, তাতে চমৎকার একটা মিষ্টি গন্ধ আছে। আবার মহেশখালীর পানও ভালো লাগে, এ ছাড়া বরিশাল, মাদারীপুর, খুলনা অঞ্চলের পানও খারাপ না, ভালোই লাগে। আর সার্বিকভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের সব অঞ্চলের পানই ভালো। দেশের বাইরে পান খাওয়া বলতে, আমি বলব-কলকাতায় অনেক ধরনের পান পাওয়া যায়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কাকদ্বীপের পান নামকরা। যদিও আমার সেখানে যাওয়া হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে আমি অনেক ধরনের পান খেয়েছি।
দিনে ছয়-সাতটা
প্রথম দিকে দোকান থেকে কিনে খেতাম; কিন্তুদেখলাম দোকানের পান আমার ভালো লাগে না। আর আমার তো উনিশটা দাঁত নেই, অনেক দিন ধরেই সতেরোটা ছিল না, নতুন করে দাঁত লাগাতে গিয়ে আরো দুটি তুলে ফেলতে হয়। সে জন্যই মূলত কাঁচা সুপারি খেতে হয় আমার। দোকানে খুব বড় বড় সুপারি থাকে, আমার খেতে খুব অসুবিধা হয়। আর এমনিও নরমাল শুকনো সুপারি, খুব চিকন করে কাটা, সেটাও খাই; কিছু রাখিও সঙ্গে। আমি যেখানেই যাই, কাঁচা সুপারি কেটে নিয়ে যাই, অনেক দিন থাকেও। এই সুপারিটাও-আমি এখন দুই রকমের সুপারি খাই। কাঁচা সুপারি খাই আর একটা, যেটাকে বলে মাদায়া সুপারি-ভেজানো সুপারি, এর গন্ধটা অনেকেই পছন্দ করে না। কিন্তু ওই শুঁটকির মতো, যারা একবার খেতে অভ্যস্থ হয়ে যায় তাদের ভালো লাগে, আমি এটাও খাই। আমি যে খুব বেশি পান খাই তা না। ওই চা খাওয়ার পর পান খাই। চা দিনে চার-পাঁচ কাপ খাওয়া পড়ে, এ ছাড়া তিন বেলা খাওয়ার পর খাই, মূলত ছয়-সাতের বেশি দিনে পান খাওয়া পড়ে না। তো পান আমি যতটা না খাই, তার চেয়ে পান খাওয়াতে হয় একটু বেশি। অনেকেই আমার পান পছন্দ করেন, আর আমিও পান খাওয়াতে পছন্দ করি।
পান নিয়ে প্লেনে
একবার দুবাই কি আবুধাবি এয়ারপোর্টে, সম্ভবত দুবাই। আমরা কাতার কিংবা আমিরাত যাচ্ছিলাম, মনে নেই ঠিক; প্লেনে বসে চা খেয়েছি। ব্যস, পান মুখে দিয়ে নামলাম আর কি! কাস্টমসে-ইমিগ্রেশনের ওখানে ধরল আমাকে। বলল, তুমি পান খাচ্ছ? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। তো উনি বিশুদ্ধ পান উচ্চারণ করলেন; কিন্তু ওরা পান কোথা থেকে বলবে, আমি পানের আরবি জানি না। কতক্ষণ পর উনি আবার বললেন যে পান! আমি বললাম, আমি জাপান না, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তো উনি বললেন যে আই নো ইউ আর ফরম বাংলাদেশ। রেগে গেছেন একেবারে। তারপর ত্যাড়া মুখ করে বললেন, তুমি তো পান চিবোচ্ছ। আমি বললাম-হ্যাঁ, পান খাচ্ছি। তারপর দেয়ালের দিকে তাকালেন, আমি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি, পরিষ্কার করে লেখা-পান খাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমি তখন বললাম, স্যরি আমি এটা জানতাম না। তো বলল, থ্রো ইট। ডাস্টবিন দেখিয়ে দিল। আমি ফেলে দিলাম।
আরেকটি ঘটনা, আমি সেন্ট পিটার্সবার্গ ইউনিভার্সিটিতে কবিতা পড়তে যাচ্ছি। পানের কৌটা নিতে মনে ছিল না। তাই প্লেনে খুঁজতে লাগলাম। না পেয়ে মুখ ভার করে বসে থাকলাম। ওখানে গিয়ে পৌঁছলাম বিকেলে। একটা ইন্ডিয়ান শপে গেলাম। গিয়ে দেখি পান নেই, কী করব, পানের বদলে ভুটকা! কিনলাম কয়েকটা। আমাকে বলে-এটা খেতে পারেন, পানের মতোই লাগবে। গোটা দশেক ভুটকা কিনলাম, অনেক দাম রাখল। তারপর রাতে, এটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার, কবিতা পড়ার পর এক সিলেটি মহিলাকে দেখে মনে হলো এই মহিলা পান খান। তো আমি গিয়ে বললাম যে আপনি পান খান? তো উনি বললেন-‘হ্যাঁ বাবা, খাই।’ আমি বললাম, আমাকে কি একটু দেবেন? তো তিনি একটু আমাকে পান দিলেন, যে পানটা দিলেন, সেটা পান না বলে পানসত্ত্বই বলা যেতে পারে, চকোলেট চকোলেট পান। তাও আমি খুব কৃতজ্ঞ মাহিলাটির কাছে।
পান দেয় শাণ
পান চিন্তা করতে কিছুটা সাহায্য করে। রাত জেগে যখন লিখি, তখন এত রাতে কে আমাকে সঙ্গ দেবে। পানকেই হাতের কাছে পাই। কনসেনট্রেট করার ক্ষমতা দিয়ে দেয়। আর পান খাওয়া মানে রিলাক্স। পান যারা খায় তাদের বলা হয় যে ‘এরা সুখী মানুষ’। পান যখন খাচ্ছে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারো কোনো ক্ষতি করছে না, চিন্তায় জড়তা আসছে না; বরং চিন্তায় কিছুটা সাহায্য করছে। একটু রিলাক্স মুড এনে দেয় পান। পানের অনেকগুলো গুণের মধ্যে এই গুণগুলো আছে। তবে পান বানানো কিন্তু বেশ ঝামেলার।
অনুলিখন : মুকুল মল্লী
দায়স্বীকার : কালেরকণ্ঠ
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/samoiki
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801720070848
🔗 E-MAILL
samoikionline@gmail.com

No comments