আসাদ চৌধুরীর ‘বারবারা বিডলার’ কবিতাটি যেভাবে হলো গান ।। মিশু খান

 

আসাদ চৌধুরীর ‘বারবারা বিডলার’ কবিতাটি যেভাবে হলো গান
মিশু খান

চলে গেছেন কবি আসাদ চৌধুরী। কবিতার পাশাপাশি গানের জগতেও ছিল তাঁর বিচরণ। কাঙালিনী সুফিয়া ও কবিয়াল বিজয় সরকার তাঁরই আবিষ্কার বলা যায়। তাছাড়া আসাদ চৌধুরীর ‘বারবারা বিডলারকে’ কবিতাটি উঠে এসেছে গানেও। এ কবিতা থেকে ব্যান্ড শহরতলী তৈরি করেছে তাঁদের ‘আসাদের খোলা চিঠি’ গানটি। কবির মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন মনে এই গান তৈরির নেপথ্যের গল্প শোনালেন ব্যান্ডটির ভোকালিস্ট মিশু খান। নিচে হুবুহু তুলে ধরা হলো সেই স্মৃতিকথা।
 
প্রথমে আমরা গান নিয়ে কাজ করতাম। পাশাপাশি কবিতা নিয়েও চর্চা ছিল। ফলে ব্যান্ডের সবার মধ্যে চিন্তাভাবনা ছিল কবিতা নিয়ে কাজ করব। ব্যান্ডে তখন গালিব আজিম ও আমরা আরও যাঁরা ছিলাম, সবাই মিলে চিন্তা করছি কবিতার সঙ্গে গানের কীভাবে মেলবন্ধন ঘটানো যায়। তো আসাদ চৌধুরীর এই ‘বারবারা বিডলার’ কবিতা থেকেই আমরা প্রথম কাজ করতে শুরু করি। ২০০৫-০৬ সালের দিকে গানটি রেকর্ড হয়। কবিতাটি হুবহু রেখে গানটিতে সমসাময়িক কিছু কথা নিজেদের মতো উপস্থাপন করি। লিরিক ও কবিতার সংমিশ্রণ করে একটি ডেমো ভার্সন তৈরি করি। পরে সেটি আসাদ চৌধুরী স্যারের কাছে নিয়ে যাই। কোনো-না-কোনোভাবে যোগাযোগ করে তাঁর বাসায় ওই ডেমোটি নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে আমি খুব ভয়ে ছিলাম, তাঁর কবিতা নিয়ে কাজ করছি, বিষয়টি তিনি কীভাবে নেবেন? কবিতা নিয়ে গানে যে কাজ করা যায়, এ বিষয়টি হয়তো অন্যভাবেও নিতে পারেন। অথবা কবিতায় কেন গান করলাম, সেটা ভেবে রাগ করতে পারেন। এমন কিছু ভয় ছিল।
কিন্তু কবিতাটি নিয়ে আমরা কাজ করছি, এটা শুনে খুব খুশি হন তিনি। পজিটিভলি নিয়ে বললেন, ‘আসলে আমার খুব ভালো লেগেছে তোমরা এটা নিয়ে কাজ করছো।’ শেষে তাঁকে যখন গানটা শোনাই, পুরো গানটি হেডফোনে শোনার পর তাঁর চোখে পানি চলে আসে। তিনি আমাদের বলেন, ‘খুবই খুবই খুবই ভালো লেগেছে’। জানালেন, এটা নিয়ে যে আমরা কাজ করতে পারি, সেটা তিনি ভাবতে পারেননি এবং তিনি আমাদের খুব অনুপ্রেরণা দেন। বলেন, ‘যে ধরনের গান নিয়ে তোমরা কাজ করছ তা খুবই চমৎকার।’
সত্যি কথা বলতে, ওই গানের পর থেকেই আমরা এক ধরনের সাহস পাই কবিতা নিয়ে কাজ করার। যেহেতু এত গুণী একজন মানুষ তাঁর কবিতা নিয়ে কাজ করার ফলে খুশি হয়েছেন, তাই আমাদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মায় এ ধরনের গান করা যেতে পারে। আসলে থিয়েট্রিক্যাল রক নিয়ে কিছু করা যায়, সেটা তখনই মাথায় আসে। কারণ, এ ধরনের গান নিয়ে দেশে তেমন কাজ হয়নি। অনেকে খুব কট্টোরভাবে নেয় এসব। তাঁদের মতে, কবিতা কবিতার মতো থাকবে, কেন গানের মতো হবে! কবিতা পড়ার যে চলন, সেটাই-বা মানুষ কীভাবে নেবেন, সেসব ভাবনা ছিল আমাদের। আসাদ চৌধুরী আধুনিক কবি মানুষ ছিলেন, ফলে তিনি খুব সহজভাবে নিয়েছেন। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই আমরা শহরতলীর কালজয়ী ‘জেলখানার চিঠি’ গানটি করার সাহস পেয়েছি। ওই সময় তিনি যদি ইগনোর করতেন, তাহলে থিয়েট্রিক্যাল রক বা কবিতা বা সংলাপ নিয়ে কাজ করার আগ্রহ আমাদের আর থাকতো না। শহরতলীর জন্ম কিংবা কবিতা নিয়ে কাজ করার বিষয়টি তাঁর থেকেই শুরু হয়েছে।
পরবর্তীতে গানটি যখন ডেমো থেকে মাস্টার বা ফাইনাল ভার্সন করা হলো, তখন আসাদ চৌধুরীকে জানাই-গানটির ভিডিওতে তাঁকে রাখতে চাই। তখনও তো তাঁর ভালোই বয়স এবং এ কারণে আমরা খুব ভয়েও ছিলাম ভিডিওতে তিনি সময় দিতে পারবেন কি-না। কিন্তু একদম অবাক করে দিয়ে অকপটে তিনি জানতে চাইলেন আমরা কখন যেতে পারব, কবে শুটিং হবে? শুটিংয়ের দিন কোনও একটি চ্যানেলে তাঁর ইন্টারভিউ ছিল, সেটা শেষ করে আমাদের সময় দেন। মনে পড়ে, রাত ১০টা থেকে শুরু করে রাত ২টা পর্যন্ত আমরা তাঁকে ও তাঁর ফ্যামিলিকে কষ্ট দিয়েছি। কারণ, একটা শুটিং হলে ১০-১২ জন মানুষ তো এমনিতেই থাকেন।
গানটির যখন শুট করি, আসাদ চৌধুরী খুবই ন্যাচারাল ছিলেন। কৃত্রিমতা ছিল না। তাঁর চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছিল, আমি খুব ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম। অভিনয়ের অংশে তাঁর চোখ দিয়ে যে জল আসে, সেটা সত্যি সত্যিই চোখের জল। আজ যখন তাঁর মৃত্যুর খবর পেলাম, তখন খুব মনে পড়ছিল ওই দিনের ঘটনাগুলো। যখন আমরা তাঁর কাছে গিয়েছিলাম, তিনি যে পরিমাণ উৎসাহ দিয়েছেন, শুটিংয়ের সময় রাত ২টা পর্যন্ত জ্বালাতন করেছি- সেসব ভাবছিলাম। যাঁর কবিতা নিয়ে কাজ করেছি, তিনি মনে করেছিলেন আমরা যা করছি তার পুরোটাই সঠিক- এই স্মৃতিগুলো তো ভোলার নয়।

অনুলিখন: রাব্বানী রাব্বি
দায়স্বীকার itvbd.com

No comments

Powered by Blogger.