কবি-কবিতা: রাসুলে খোদা সা.-এর অনুরাগ ও উৎসাহ ।। মতিউর রহমান মল্লিক

 

কবি-কবিতা: রাসুলে খোদা সা.-এর অনুরাগ ও উৎসাহ

প্রায় দু’হাজার বছরের সুপ্রাচীন সাহিত্য হচ্ছে আরবি সাহিত্য। বলা বাহুল্য, এখনও বহু পাঠককে প্রাচীন আরবি কবিতাগুলো প্রবলভাবে আলোড়িত করে। আরবদের জীবনাচারের প্রায় সকল অঞ্চলে অনস্বীকার্যভাবে অমানবিকতা থাকলেও কাব্য চর্চার ব্যাপারে তাদের খ্যাতি ছিলো কিংবদন্তীর মতো। তারা তাদের চিত্তবৃত্তির সমূহ প্রকাশের জন্য বস্তুত বেছে নিয়েছিলো ছন্দের দোলায়িত ব্যঞ্জনা আর ভাবের আনন্দময় গতিবহতা, অর্থাৎ কবিতার কলকল্লোলিত ফসলা প্রান্তরকে তার বেছে নিয়েছিলো । তাদের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও আনুষ্ঠানিকভাবে ‘উকজে’র মেলায় কবিতা আবৃত্তিতে অংশ নিতেন। বছরের শেষে সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোকে কাবা ঘরের দেয়ালেই ঝুলিয়ে রাখা হতো, অনিন্দ্য সুন্দর মিসরীয় বস্ত্রখন্ডের ওপর বর্ণালী অক্ষরে লিপিকৃতির পরপর। 
আরবদের চমৎকার এক প্রত্যয় ছিলো যে, কবিতা হচ্ছে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার অভিজ্ঞান। জীনেরা এবং শয়তানেরাও তাদের কবিদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। তাদের কবিরাই ছিলো তাদের গেত্রের মুখপাত্র, পথ-প্রদর্শক, পরামর্শদাতা এবং শৌর্যবীর্যের মূর্ত প্রতীক। 
জীবিকা উপার্জনে এবং বাঁচার আকুলতায় প্রাচীন আরবদের জন্য যুদ্ধ ছিলো  অপরিহার্য। আর যুদ্ধের জন্য অপরিহার্য ছিলো সমরাস্ত্রের। কিন্তু তারচেয়ে প্রয়োজন ছিলো  প্রবল প্রতাপ যোদ্ধার-তার দৃঢ় মনোবলের, তার অসম সাহসের, তার সৌকর্যমন্ডিত শৌসর্যবীর্যের, কিন্তু তাকে অর্থাৎ যে দুর্দান্ত যুদ্ধবাজকে এবং তার গুণাবলীকে বিপুল বন্যাবেগে প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে কবিই ছিলেন একমাত্র, কবিই ছিলো সর্বময়। অতএব কবিদের শব্দাস্ত্রই ছিলো তাদের সৈনিকদের সমরাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্যাতীত সন্দ্বীপন। রণসংগীত রচনার ভেতর দিয়েই কবিরা এই দুর্লভ কর্মকান্ড উদযাপন করতো বলে তাদের অপ্রতিহত প্রতিপত্তি ছিলো, সর্বস্পর্শী অধিপত্য ছিলো । 
মূলত কবিদের প্রধান কর্তব্য ছিলো এমন সব কবিতা রচনা করা যার মধ্যে থাকবে নিজস্ব গোত্রের পরাক্রম বীর্যবত্তা, সাহসিকতা, যশঃকীর্তন এবং গৌরব গাঁথা। মর্সিয়ার মাধ্যমে অর্থাৎ শোকগাঁথার ভেতর দিয়ে মৃত্যুপ্রাপ্ত ব্যক্তির বীরত্ব, মর্যাদা ও খ্যাতির কথা স্মরণ করানো ছিলো কবির আরো একটি কাজ। এ কাজের উদ্দেশ্যেই থাকতো মৃতজনের গোত্রের লোকদেরকে প্রতিশোধের জন্য প্ররোচিত করা, কবিতায় কোনো গোত্রের কোনো ব্যক্তির কুৎসা রচনার অথবা বিদ্রুপাত্মক ভাষায় হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য গাঁথা সৃষ্টির অন্যতম দায়িত্ব ছিলো তখনকার কবিদের। ফলে, বিবাদ-বিসম্বাদ আর ক্লিন্নকলহ সংঘটিত করার ব্যাপারে কবিতার এক একটি চরণের ভূমিকা ছিলো এক একটি বিষাক্ত তীরের ফলার চেয়েও মারাত্মক। কবিদের কদরও ছিলো তাই অত্যাধিক। 
নতুন চারণ ভূমির প্রয়োজন- কবির পরামর্শ নাও, অন্য কোথাও তাবু খাটাতে হবে- কবির মতামত চাও। আসল কথা, কবিই ছিলো সে সমাজের বিশেষজ্ঞ, উপদেষ্টা এবং সমুহ শক্তি। আর কবিতা ছিলো তাদের জীবন ও প্রকৃতির অমোঘ নিয়ন্তা। এক প্রাচীন আরবের রক্ত-মাংসে, অস্থি মজ্জায়, আশা-নিরাশায় পাওয়া না পাওয়ায়, আনন্দ-বেদনায়, প্রেম ও বিরহে, জীবন ও মৃত্যুতে কবিতা অস্তিত্বের মতো অপরিহার্য হয়ে গিয়েছিলো এবং সেই জন্য তাদের মধ্যে কোনো কবির আবির্ভাব ঘটলে তাকে বরণ করে নিতা আনন্দ-উৎসব করে, প্রীতিভাজের আয়োজন করে। 
সেই প্রাচীন সমাজে ‘হিজা’ নামে এক ধরনের কবিতা ছিলোÑ শায়কের চেয়ে তীক্ষè, লু-হাওয়ার চেয়ে তীব্রতর। একটি হিজা তৈরি হওয়ার সাথে সাথে তা এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত পর্যন্ত মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তো। এক মুহুর্তে উস্কিয়ে দিতো আরব জীবনের নিষ্ঠুরতা, মরুর জীবনের নৃশংসতা। সে দুর্দান্ত আরব ভয় করে না কোনো কিছুকেই, যদি ঘটানাক্রমে তারই জন্য রচিত হয়ে যায় কোনো হিজা, তাহলে সে মুহূর্তের মধ্যে অনুভব করতে থাকে অসম্ভব এক মৃত্যু যন্ত্রনা। যার নিরাময় নেই, উপশম নেই প্রতি-উত্তরে আর একটি জুতসই হিজা না লেখা পর্যন্ত। 
গোত্রীয় ও সামাজিক অবস্থা সংঘাত, সংঘর্ষ অথবা রক্তপাতকেই প্রশ্রয় দিয়ে যায়। কবি এবং কবিতা অস্তিরতার নেতৃত্ব দিয়ে চলে। এমনি এক ভুখন্ডে সর্বপ্লাবী অস্তিত্ব ছাড়া যে কোনো সুকুমার বৃত্তি ও সৃজনশীলতার যথার্থ উদ্ধার ছিলো  অসম্ভব। সমবেত দরকারেই একজন মহানায়কের আবির্ভাব অত্যাসন্ন হয়ে পড়েছিলো  তখনই।
রাসুলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত পৃথিবীর অন্ধকার দূর করার এক মহান ও গুরুত্ববহ দায়িত্ব লাভ করেছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই তাকে এ দায়ীত্ব দিয়েছিলেন। এই যে দায়িত্ব, এ দায়িত্ব পালন সম্ভবই ছিলো  না কোনো সাধারণ নায়কের এবং সম্ভব ছিলো  না বলে একজন মহানায়কের জন্য যে গুণ থাকা দরকার, সেই সব গুণই তাকে দান করেছিলো । 
রাসুলে খোদ সা. যে মানব জাতির এক অবিসংবাদী মাহানায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তার জন্মগ্রহণের আগেই তা জনতে পেরেছিলেন মা আমিনা। 
মুহাম্মাদ সা. গর্ভে আসার পর মা আমিনার কাছে অপরিচিত কোনো এক আগন্তুক আসেন এবং তাকে বলেন, আপনি যাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, এ যুগের মানব জাতির মহানায়ক তিনিই। 
রাসুলে খোদাকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস কররে বলতেন... আমি পিতা ইব্রাহিমের দোয়ার ফল এবং ভাই ঈসার সুসংবাদের পরিণতি। আমি গর্ভে আসার পর আমার মা স্বপ্নে দেখেন যে, তার মধ্যে থেকে একটি জ্যোতি বের হলো যার দ্বারা সিরিয়ার প্রসাদসমূহ আলোকিত হয়ে গেলো...
একজন মহামানবের আগমন যেমন ব্যতিক্রমী, তেমন ব্যতিক্রমী তার আলোকিত জীবন প্রবাহ। রাসুলে খোদা চেয়েছিলেন সমস্ত দুনিয়াকেই নিরাময় করতে। নিরাময় করতে চেয়েছিলেন বলেই ব্যতিক্রমী জীবনের সমস্ত তার আয়োজন কাজে লাগিয়েছিলেন আদর্শনিষ্ঠ একদন মানুষ সংগঠনে। তার এই লোকগঠনের প্রবলতার প্রয়াস ছিলো সমাজের প্রতিটি অবধারিত বাঁক-বঙ্কিম পথমোহনায়। 
শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনেই সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছিলেন কিংবা সমরনৈতিক প্রয়োজনকেই একমাত্র বিষয় বলে মনে করে নিয়েছিলেন তা নয়- বরং একটি সম্যক পরিবর্তনের লক্ষ্যে যেখানে যে পরিমাণ বিচক্ষণ জনসম্পদের আবশ্যকতা ছিলো, সেখানে সে পরিমাণ জনসম্পদই তিনি যথার্থভাবে গড়ে তুলেছিলেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বিন মুফতী আমিমুল ইহসান এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনসম্পদের একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন- উওহ হার ফন মেঁ কামেল ওয়া মাহের কে-
রাসুলে খোদা একটি সত্য এবং সাম্যের সমাজ গড়ার কাজ শুরু করতেই কায়েমি স্বার্থবাদী নেতারা ও কবিরা প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। এক নতুন জীবন প্রতিষ্ঠার পথে নেতারা বাঁধার সৃষ্টি করতে থাকে-গণসাধারণকে সংগঠিত করা মধ্য দিয়ে। আর কবিরা কবিতা রচনার ভেতর দিয়ে ইসলাম ও রাসুল মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে গেয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করার কাজে উঠে-পড়ে লেগে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিকতার বাইরে চলে গেলে রাসুল তার সাহাবিদের ডাক দিয়েছিলেন:
যারা হাতিয়ারের দ্বারা আল্লাহ ও তার রাসুলের সাহায্য করে, কথার দ্বারা [অর্থাৎ কবিতার দ্বারা] আল্লাহর সাহায্য করতে তাদের কে বাঁধা দিয়েছে? রাসুলে খোদার একান্ত সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা কবি সাহাবিদের ভেতর থেকে হাসসান বিন সাবিত, কা’ব বিন মালিক, আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা. প্রমুখ ঐ উদাত্ত আহবানে সাড়া দিলেন। মসজিদে নববিতে কবি হাসসানের রা. জন্য মিম্বরা তৈরি করা হলো। রাসুলে খোদার নির্দেশনা অনুযায়ী আবু বকর রা.’র পরামর্শ নিয়ে হাস্সান ইসলামের চরমতম শত্রু কবিদের দাঁতভাঙা জবাব দিতে লাগলেন। হাস্সান বিন সাবিত কবিতা আবৃত্তি শুরু করলে রাসুলে খোদা তার জন্য দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! রুহুল কুদুসকে দিয়ে তাকে তুমি সাহায্য করো। হাস্সান বিন সাবিতের কবিতা শুনে রাসুলে খোদা মুগ্ধ হয়ে বলতেন: এ কবিতা তাদের জন্য তীরের  আঘাতের চেয়েও সাংঘাতিক। 
এই সাবাহি কবি হাস্সান বিন সাবিতের রা. প্রতি রাসুলে খোদার ভালোবাসা ছিলো এতোটা প্রবলতর যে, মিসরের রোমক শাসক দুই অপরূপা সুন্দরী উপঢৌকন পাঠালে শিরী নাম্নী অনিন্দ্য সুন্দরী রূপবতীকে তিনি তার সাথেই বিয়ে দিয়ে দেন। শুধু কবিতা লেখার অপরাধেই কোনো কবির প্রতি রাসুলে খোদার আদৌ অবহেলা ছিলো না; বরং কবিদের প্রতি তার ছিলো এক অপরিসীম আস্থা এবং আস্থা ছিলো বলেই কবি আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা. একদা রাসুলে খোদার পক্ষ থেকে পেয়েছিলেন সেনাপতির দায়িত্বও। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি একজন ঈমানদারের জন্য আল্লাহর দেয়া সর্বোত্তম যে উপাধি-শহিদ, সেই শহিদ খেতাব অর্জন করার মধ্য দিয়ে চিরকালের জন্য খোদ খোদারই তত্ত্বাবধানে চলে গিয়েছিলেন।
রাসুলে খোদা ছিলেন সত্যিকার অর্থেই কবিদের প্রতি ক্ষমাসুন্দর। প্রাণদণ্ডের মতো অপরাধ করার পরও তার মার্জনা পেয়েছে ঐ মহানুভব মানুষের। কবি কা’ব বিন জোহায়েরের ইসলাম গ্রহণের ইতিহাসের সাথে সেঁটে রয়েছে তেমনি একটি ঘটনা:
কবি কা’ব বিন জোহায়েরের ভাই বুজায়ের বিন জোহায়ের ইসলাম গ্রহণ করলেন। কা’ব বিন জোহায়ের ভীষণ বিক্ষুব্ধ হলেন। বুজায়ের এবং রাসুলে খোদাকে নিয়ে লিখলেন অত্যন্ত আপত্তিকর সব কবিতা। ইসলামের সমূহ ক্ষতি হবার সম্ভবনা দেখা দিলো। কবি কা’ব বিন জোহায়েরের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করলেন রাসুল মুহাম্মদ সা.। কবি আত্মসমর্পণ করলেন প্রেমের নবির কাছে। শুধু আত্মসমর্পণ করলেন না, কবি বানাত সু’আদু’-র মতো এক দীর্ঘ কবিতাও পড়ে শোনালেন। মানবতার নবি এতো খুশী হয়ে গেলেন যে, কবির মৃত্যুদণ্ডাদেশ তো রহিত করলেনই; উপরন্তু তাকে তার গায়ের চাদরও উপহার দিলেন। এই চাদর পরবর্তীতে কিনে নেওয়ার জন্য পরবর্তী সময়ে আমির মুআবিয়া রা. কবির দরবারে বহুবার ধর্ণা দিয়েছেন। কিন্তু কবি তার এই প্রাণের ঐশ্বর্য বিক্রি করার জন্য অমৃত্যু কখনোই সম্মত হননি। 
কবিদের মর্যাদা ছিলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সত্যি অপরিসীম। বক্তৃতা দেবার সময় কখনো কখনো তিনি তাদের কবিতার উদ্ধিৃতি দিতেন। ‘সাবা মুয়াল্লাকা’র কবি লবিদ রা.‘র কবিতার দুটি চরণ এভাবেই অমর হয়ে আছে:
আলা কুল্লু শাইয়্যিন মা খালাল্লাহ বাতেলু
ওয়া কুল্লু নায়িমিন লা মহালাতা যাইলু। 
অর্থাৎ সাবধান হও, আল্লাহ ছাড়া আর সবই মিথ্যা এবং সব নেয়ামতই একদিন অবলুপ্ত হবে, শুধু অবলুপ্ত হবে না জান্নাতের সম্ভার। 
রাসুলে খোদা যেমন কবিদেরকে ভালোবেসেছিলেন, তেমনি কবিতার প্রতিও তার অনুরাগ ছিলো বিস্ময়কর। উম্মি নবি কবিতা লিখতে পারতেন না, কিন্তু মুখে মুখে বানিয়ে ফেলতেন দু’এক চরণ। যেমন-
আনান্নাবিয়্যু লা কাজিব, আনা ইবনু আবদিল মুত্তালিব।
অর্থাৎ আমি নবি, মিথ্যাবাদী নই। 
আমি আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর। 
রাসুলে করিম সা. মুখে মুখে রচনা করেছিলেন এই দু’টি চরণও:
হাল আন্তে ইল্লা ইছবাউন দুমিতে
ওয়া ফি সাবিলিল্লাহিজ মা লাকিতে।
অর্থাৎ হে আঙ্গুলী! তুমি তো একটি আঙ্গুল বৈ কিছুই নও। সুতরাং যা কিছু হয়েছে, তা তো আল্লাহর রাস্তায় হয়েছে- তাই এতে অনুশোচনা ও দুঃখ কিসের?
ওহুদের যুদ্ধের এক পর্যায় রাসুল সা. একটি গর্তে আশ্রয় নিলেন। তবু একখণ্ড পাথরের আঘাতে তার আঙ্গুলী হতে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকলে তিনি আবৃত্তি করতে লাগলেন উল্লেখিত কবিতাটি। 
রাসুলে খোদার মুখে মুখে রচিত আর একটি কবিতা যা খন্দকের যুদ্ধে খন্দক খুঁড়তে খুঁড়তে তিনি তার সাহাবিদেরকে নিয়ে সমবেত কণ্ঠে গাইতেন:
আল্লাহুম্মা লা আইশা ইল্লা আইশাল আখিরা
ফাগফিরিল আনসারা ওয়াল মুহাজিরা। 
অর্থাৎ হে আল্লাহ! পরকালের জীবন ব্যতীত আর কোনো জীবন নেই, তুমি আনসার এবং মোহাজেরদের ক্ষমা করে দাও। 
মুখে মুখে বলা তার আরো কিছু কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। যেগুলো অন্তমিলের দিক থেকে এবং ভাব-ভাবনার তৎপর্যতায় নিঃসন্দেহে বৈশিষ্ট্যপুর্র্ণ। এসব কবিতার চরণ অমৃত চিরকালই কবি ও কবিতার পাঠকদের সত্যিাকার অর্থে রাসুল সা. যে একজন সর্বাধুনিক মানুষ ছিলো তা অনুধাবন করবার ব্যাপারে উৎসাহ যুগিয়ে যাবে। 
একজন উম্মি নবির পক্ষে মুখে মুখে কবিতা তৈরি করা কি করে সম্ভব হয়েছিলো? মূলত রাসুলে খোদা সা. ছিলেন শুদ্ধতম মানুষ। তিনি নিজেই বলতেন: 
আনা আফসাহুল আরব... ... ... ইন্নি মিন্ কুরাইশিন্ অ-ইন্নি নাশা’তু ফি বাবি সা’আদি বিন বক্র। 
অর্থাৎ আমি শুদ্ধতম আরব! কেননা, কুরায়েশদের ভেতরেই আমার জন্ম এবং সায়াদ বিন বকর গোত্রে আমি আমার শৈশব কাটিয়েছি। 
ওমর রা. রাসুলে আল-আরবিকে প্রশ্ন করেছিলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমাদের মধ্যে বড় হলেন অথচ কথা বলেন এতো সুন্দর ভাষায়...। অন্য কোনো কোনো সাহাবিও কখনো কখনো তার সুন্দর সুন্দর কথায় বিমুগ্ধ হয়ে- ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি (চমৎকার) শুদ্ধভাষী, কোনো ব্যক্তিকেই আমি আপনার চেয়ে সুন্দর ও মধুর (ভাষায়) কথা বলতে (শুনিনি) দেখিনি‘ মন্তব্য করলে সাইয়েদুল মুরসালিন রাসুলে মকবুল সা. উত্তর করতেন, ঠিকই বলেছো, এ যে আমার অধিকার, কারণ কোরআন তো আরবি মুবিন ভাষায় আমার নিকটই নাযিল হয়েছে। 
নবুওয়াত প্রাপ্তির আগেই রাসুলে খোদা সা.-এর মধ্যে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের ওপর একটি অসাধারণ দখল এসে গিয়েছিলো প্রকৃতিগতভাবে একজন আরব হবার কারণে। তাছাড়া ভাষার গতি ও লাবণ্যের প্রতি তার একটি স্বভাব-সুলভ কৌতূহলও ছিলো। নাজরানের বিখ্যাত দার্শনিক ও নেতৃস্থানীয় খ্রিস্টান পাদরি ছিলেন আরবের বিখ্যাত বাগ্মী। তার বক্তৃতা ছিলো সাবলীল, কিন্তু ভাবাবেগ ছিলো খরস্রোতেরই অধিক। তার বিষয়বস্তু ছিলো ধার্মিকতার আদর্শে উজ্জ্বলতর। কুস বিন সা’ইদাহ আল ইয়াদি নামের এই অসাধারণ বাগ্মী উ’কাজের মেলায় বক্তৃতা করতেন। পারস্য সম্রাট কিসরা পর্যন্ত তার বক্তৃতা শুনে মন্তব্য করেছিলেন, ‘তুমি ব্যতীত আরবদের আর কোনো বাগ্মী না থাকলেও, তাদের জন্য তুমি একাই যথেষ্ট।‘
নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে রাসুলে খোদ কুস-এর একটি বক্তৃতার আসরে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তার বক্তৃতা শুনে দারুণভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই কুস বিন সাই’দাহ আল ইয়াদির সাথে রাসুলে খোদার একটি চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো এবং তিনি তাকে ইসলাম প্রচারের কাজেও লাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। 
বক্তৃতার কোনো পর্যায়ে ‘আম্মা বায়াদ‘ শব্দ দুটির আজো যে ব্যবহার দেখা যায় তা এই কুস আল ইয়াদিরই প্রবর্তিত। 
কবিতা সম্পর্কে সারওয়ারে দো-আলমের সা. কোনো ধারনা আদৌ অস্পষ্ট ছিলো  না। তিনি বলিষ্ঠ ভঙ্গিতেই উচ্চারণ করেছিলেন, ‘নিঃসন্দেহে কোনো কোনো কবিতায় রয়েছে প্রকৃত জ্ঞানের কথা’। 
‘কবিতা কথার মতোই। ভালো কথা যেমন সুন্দর, ভালো কবিতাও তেমনি সুন্দর আর মন্দ কবিতা তো মন্দ কথার মতো মন্দই (বৈ নয়)’। 
কবিতা সম্পর্কে বিশ্বনবি এতোটা উদার ছিলেন যে, তিনি বলতেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের কবিতা শেখাও তাহলে কথা মিষ্টি এবং সুরেলা হবে’। 
যেহেতু তিনি কবিতা সম্পর্কে ধারণা করতেন, ‘কবিতা হচ্ছে, সুসামঞ্জস্য কথামালা। সত্যনিষ্ঠ কবিতাই সুন্দর কবিতা। আর যে কবিতায় হয়েছে সত্যের আপলাপ সে কবিতায় নেই মঙ্গল’। সেহেতু মন্দ এবং বাজে কবিতা সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকাই স্বাভাবিক। তিনি এ ব্যাপারে অত্যন্ত জোর দিয়ে যে কথা বলেছেন, তা হচ্ছে ‘তোমাদের কারো পেটে (এ ধরনের বাজে) কবিতা থাকার চেয়ে সে পেটে পুঁজ জন্মে, (আবার) তা পচে যাওয়া অনেক উত্তম’। 
সায়্যেদুন্নবির কবিতা শোনার মতো ধৈর্যও ছিলো এবং অবহিত কান ছিলো। তিনি কবিতা শুনবার জন্য কখনো কখনো কবি-সাহাবির বাড়িতেই হাজির হয়ে যেতেন। শুধু শুনতেন না, সংশোধনও করে দিতেন। একবার এক কবি তার সামনে আবৃত্তি করলেন: 
কাফাশশাইবু ওয়াল ইসলামু বিল র্মাই নাহিয়ান...
অর্থাৎ বার্ধক্য এবং ইসলাম মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট। 
রাসুল সা. কবিতার এই অংশটি কবিকে সংশোধন করতে বললেন এভাবে:
কাফাল ইসলামু ওয়াশশাইবু বিল মারই নাহিয়ান...
শাইবু শব্দটিকে কবি ছন্দের স্বার্থেই ইসলাম শব্দের আগে বসিয়েছিলেন। কিন্তু রাসুল আল আমিন সা. তা সমর্থন করেননি। যদিও উপিস্থত কোনো কোনো সাহাবি ছন্দ নষ্ট হবার বিষয়টির প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। আসলে তিনি কবিতার আইনের চেয়ে ভাব-ব্যঞ্জনার ওপরই বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন। 
‘তোমাকে মৃত্যু একদিন অবশ্যই গ্রাস করবে’। 
যে যৌবনে, মৃত্যুবরণ করলো না 
বার্ধক্যে, অবশ্যই তাকে তার স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, 
কেননা মৃত্যু হচ্ছে এমনই একটি শরবতের পেয়ালা
যা প্রত্যেককে নিশ্চিতভাবে পান করিয়ে ছাড়বেই।’
মাহবুবে খোদা সা. উমাইয়্যার ঐ কবিতা শুনে একটি অর্থবহ মন্তব্য করেছিলেন, ‘তার কবিতা গ্রহণ করেছে ইসলাম আর তার অন্তর গ্রহণ করেছে কুফরি (খোদাদ্রোহিতা)।’ শুধু অবহিত কান আর সন্দেহযুক্ত জ্ঞান থাকলেই ঐ ধরণের মন্তব্য রাখা সম্ভব। 
রাসুলে খোদা অবশ্যই কবি ছিলেন না। মহাগ্রন্থ আল কোরআন পরিস্কারভাবে ঘোষণা করছে: 
আমরা তাকে ‘কবিতা’ রচনা শিক্ষা দেইনি এবং এ ধরনের কাজও তার জন্য অশোভনীয়’ (সূরা ইয়াসিন)। কিন্তু তিনি যে কবিতার সৌন্দর্য্য হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারতেন এবং কবিতার প্রতি তার যে একটি অর্থবহ আনুকূল্য ছিলো তা কখনোই অস্পষ্ট ছিলো না।  অত্যুক্তি হবে না, কবিরা একদিন রাসুলে খোদার সা. কাছ থেকে যে মর্যাদা এবং সমর্থন পেয়েছিলেন তা (আজ পর্যন্ত) পৃথিবীর কোনো মানুষের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি, যাচ্ছে না। বস্তুত যাবেও না। কবি এজনা পাউন্ড তার একটি সূদীর্ঘ কবিতায় রাসুল সা. প্রসঙ্গে বলেছেন- তোমরা (ইউরোপের লোকেরা) তো সব সময় কেবল হাতই পাতলে, গ্রহণ করতে চাইলে, গ্রাস করতে চাইলে কিন্তু পৃথিবীতে এসেছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি শুধু দানই করে গেছেন অনবরত। মানুষের কাছ থেকে কোনো কিছুই চাননি। 
আর বিশ্ববিখ্যাত জার্মান মহাকবি গ্যাটে রাসুল মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে তার গাঁথায় কী চমৎকারভাবেই না বলেছেন-
নিচের উপত্যকা মাঝে ফোটে তার পদক্ষেপ-তলে ফুলরাশি। আর প্রান্তর জীবন পায় তার প্রশ্বাস হতে।
মিশুক ঝরনাগুলো, মেষে তার সাথে। তখান সে চলে সমতল বক্ষে রূপালি গৌরবে। আর তাকে নিয়ে গৌরব করে সমতল। 
সত্যিকার অর্থেই রাসুল সা. কবিতার মতো ছন্দময়, হৃদয়ময় এবং সৌন্দর্যময় একটি নমনীয় পৃথিবী রচনা করতে চেয়ছিলেন। সে পৃথিবী গড়বার জন্য কবিদের প্রতিও তার আহ্বান ছিলো বড় আবেগঘন, বড় প্রাণস্পর্শী। তার একটি স্বভাব ছিলো কোনো দিকে যখন তিনি তাকাতেন আদৌ বাঁকা চোখে তাকাতেন না; বরং সম্পূর্ণভাবে নিজেকে ঘুরিয়ে নিয়েই সে-দিকে তাকাতেন। 
অর্থাৎ যে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন ঐ স্বভাবের। অর্ধেক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী মানুষ তিনি একেবারেই ছিলেন না। 
সুতরাং কবি ও কবিদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ হৃদয়ের মানুষ, পূর্ণাঙ্গ পরিতৃপ্তির মানুষ।


 


No comments

Powered by Blogger.