আহমদ বাসির স্মরণে ।। মুহম্মদ মতিউর রহমান

 
আহমদ বাসির স্মরণে
মুহম্মদ মতিউর রহমান

পৃথিবীতে প্রতিদিন অসংখ্য নবজাতকের আবির্ভাব ঘটে, আবার অগণিত মানুষ প্রতিদিন এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলেও যায়। আমরা প্রতিদিনই এ আবির্ভাব ও চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে অভ্যস্থ। নবজাতকের আবির্ভাব যেমন আনন্দের সঞ্চার করে, তেমনি কারো বিদায় হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে। তবে কোনো কোনো মৃত্যু মানুষকে বড় বেশি কাঁদায়। কারণ মানুষ হিসাবে তাদের গুরুত্ব সমধিক। তাই তাদের চলে যাওয়াটা একটা শূন্যতা সৃষ্টি করে। সে শূন্যতা অনেকদিন পর্যন্ত অনুভূত হয়। যে ব্যক্তি সমাজের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ, তার চলে যাওয়ায় সমাজের ক্ষতির পরিমাণও বেশি। তাই তার অভাব অনুভূত হয় অনেকদিন পর্যন্ত। কষ্টটা আরো বেশি মর্মবিদারী হয়, যখন কোনো ব্যক্তি তার সম্ভাবনার দ্বার-প্রান্তে এসে বিদায় নেয়। এটাকে আমরা বলি অকাল মৃত্যু। 

তবে সত্যি বলতে কি, অকাল মৃত্যু বলে কিছু নেই। কারণ যিনি সৃষ্টি করেন, সৃষ্টির সময়ই তিনি তার বিদায়ের দিন-ক্ষণ নির্দিষ্ট করে রাখেন। কারো ক্ষমতা নেই তার এতটুকু ব্যতিক্রম করার। অতএব, মহান স্রষ্টার ইচ্ছানুযায়ী জন্ম -মৃত্যু তাঁর নির্ধারিত সময়ে। তবু মৃত্যুর খবর আমাদেরকে ব্যথিত করে। কারণ সামাজিক জীব হিসাবে আমরা পৃথিবীতে পরস্পর পরস্পরের প্রতি নানাভাবে সম্পর্কিত ও সহানুভূতিশীল। এ কথাগুলো বললাম তরুণ প্রতিভাবান কবি আহমদ বাসিরের ইন্তিকালের খবর শুনে আমার মনে যে বেদনাবোধ সৃষ্টি হয়, সে অনুভূতি থেকে। 

মাত্র চল্লিশ বছরে তার ইন্তিকাল হয়। অফুরন্ত প্রাণশক্তি, অদম্য সাহস ও প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এক টগবগে যুবক। ঈমানী-শক্তিতে বলীয়ান এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী। কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, বক্তা, সংগঠক, সম্পাদক, সমাজকর্মী ইত্যাদি নানা গুণের মিশেলে গড়া এক অমিত সম্ভাবনাময় যুবক। কিন্তু সম্ভাবনার কুঁড়ি প্রষ্ফুটিত হওয়ার আগেই অকস্মাৎ অকালে ঝরে পড়লো। তার এ ঝরে পড়া অযুত প্রাণে গভীর শোকের ছায়া বিস্তার করে। তার স্বজন-পরিচিতজনরা সকলে বেদনায় বিহ্বল হয়। দোয়া করি, মহান রাহমানুর রাহীম জান্নাতের আ’লা মোকামে তাকে পরম শান্তিতে রাখুন। 

আহমদ বাসিরের সাথে আমার পরিচয় প্রায় আড়াই দশককাল আগে। তখন রাজধানী ঢাকা শহরে প্রায় প্রতিদিন সাহিত্য-   সংস্কৃতির জমজমাট আসর বসতো। আজ এখানে, তো কাল ওখানে। নবীন-প্রবীণ অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মীর প্রাণের মেলা বসতো। প্রাণখুলে কেউ স্বরচিত কবিতা পড়তো, কেউ আবৃত্তি, কেউ আলোচনা করতো, কেউ গলা খুলে গান গাইতো। আড্ডায় বসেই অনেকে কবিতা লিখতো, ঘরে ফিরেও সাহিত্য-চর্চার প্রবল তাড়না অনুভব করতো। সে উত্তাল দিনগুলোতে বিভিন্ন সাহিত্যের আড্ডায়, আহমদ বাসিরের সাথে আমার পরিচয়। বাসির তখন এক কিশোর বালক। সবে এসএসসি পাস করে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হয়েছে। বিভিন্ন সাহিত্য-সভায় তার সরব উপস্থিতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। তার স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও আলোচনা শুনে আমি তার প্রতি মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হই। তার ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব, চমৎকার বাচনভঙ্গি, সুন্দর আবৃত্তি, উদ্দীপনাময় যুক্তিপূর্ণ আলোচনা ইত্যাদি সবকিছু সহজেই সকলকে আকৃষ্ট করতো। আমিও আকৃষ্ট হয়েছিলাম এবং ধীরে ধীরে তাকে অনেকটা ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যেও পেয়েছিলাম।   

আমার মনে পড়ে, ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটি আদর্শভিত্তিক সাহিত্য সংগঠন করে নিয়মিত সাহিত্য-সভার আয়োজন করতাম। আমাদের উদ্দেশ্যে ছিল সুস্থ সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করা এবং অন্যদেরকে এতে উদ্বুদ্ধ করা। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আব্দুল মান্নান তালিব, আমি, শাহ আব্দুল হান্নান, নুরুল আলম রইসী, এ.কে.এম নাজির আহমদ, ইউসুফ আলী, মোসলেম আলী, সালেহ উদ্দিন জহুরী প্রমুখ সে সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলাম। অসংখ্য নবীন-প্রবীণদের নিয়ে ষাটের দশক জুড়ে সাহিত্য-সভা, সেমিনার ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠান করেছি। সে সংগঠন ছিল মূলত আমার মস্তিষ্ক-প্রসূত এবং সাধারণ সম্পাদক হিসাবে সংগঠনের কর্মকান্ড পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব আমার উপরই ন্যাস্ত ছিল।   

সত্তরের দশক থেকে আমি দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলাম। বিদেশে আমার পেশাগত দায়িত্ব পালনের পর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশী ছেলে- মেয়েদের বাংলা শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, বাংলা সাহিত্যচর্চার জন্য সাহিত্য সংগঠন, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি গঠন করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান উদ্যাপন, দেশী এবং প্রবাসী বাংলাদেশী কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্য সভা, সম্মেলন, পুস্তক প্রদর্শনী ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছি। 

দীর্ঘ বিশ বছর পর দেশে ফিরে আসি। ঐ সময় ঢাকায় অনেকগুলো নতুন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কাজ চলছে। ষাটের দশকে আমরা যে চারাগাছ রোপণ করেছিলাম, তা দিনে দিনে পত্র-পুষ্প-পল্লবে সুশোভিত হয়ে উঠেছে। আব্দুল মান্নান তালিবের নেতৃত্বে ‘বাংলা সাহিত্য পরিষদ’, মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর কালচার’, কবি মতিউর রহমান মল্লিকের নেতৃত্বে ‘সাইমুম’, ‘প্রত্যাশা প্রাঙ্গণ’, নাজির আহমদ ও কবি মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে ‘মাসিক কলম’, ‘পৃথিবী’ তথা ‘বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্র’ ইত্যাদি নানা সংগঠন। এ যেন বিচিত্র বর্ণ-গন্ধময় এক বর্ণাঢ্য পুষ্পিত কানন। 

অলিরা যেমন ফুলের সুঘ্রাণ খোঁজে, আমি তেমনি সব কাননে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র ফুলের সুঘ্রাণ নিতে লাগলাম। তখন এসব অনুষ্ঠানে নিয়মিত আসতেন মনীষী দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সৈয়দ আলী আহসান, ড. সৈয়দ আলী আশরাফ, অধ্যাপক শাহেদ আলী, ড. আসকার ইবনে শাইখ, সানাউল্লাহ্ নূরী, মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্, কবি আব্দুস সাত্তার, কবি আল মাহমুদ, শাহাবুদ্দিন আহমদ, কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দসহ অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষ। প্রতিভাবান তরুণদের আনাগোনা ছিল অধিক। তারা অনেকেই সাহিত্যচর্চা করে এখন খ্যাতিমান হয়েছেন। এদের মধ্য থেকেই আশির দশকের প্রতিভাবান তরুণ কবিদের আবির্ভাব। তখন তাদের মধ্যে যে সম্ভাবনা লক্ষ্য করা গিয়েছিল, পরবর্তীতে তার সম্যক বিকাশ ঘটে। তবে এখানে যাঁদের নাম উল্লেখ করলাম, তাঁরা একে একে সকলেই এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আব্দুল মান্নান তালিব বিদায় নিয়েছেন ২০১১ সালে। তরুণদের মধ্যে কবি গোলাম মোহাম্মদ, কবি মতিউর রহমান মল্লিক চলে গেছেন। সম্প্রতি ১৯ নভেম্বর, ২০২০ তারিখে আহমদ বাসিরও বিদায় নিয়ে চলে গেল। 

আহমদ বাসির ছিল এক লড়াকু সৈনিক। যত দূর জানি, সে একজন অবস্থাপন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সাহিত্য-সংস্কৃতি করার সংকল্প নিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নানা প্রতিকূল অবস্থা, অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্র্যের সাথে প্রাণপণ সংগ্রাম করে জীবন কাটিয়েছে। বিশ্বাসে স্থিতধী, সংকল্পে অটল এবং লক্ষ্যে পৌঁছবার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে অনেকটা নীরবে, নিভৃতে, নিঃসঙ্গ, নিঃসম্বল অবস্থায় সে জীবন অতিবাহিত করেছে। নিজে দারিদ্রাবস্থায় জীবন কাটানোর ফলে দরিদ্র-অসহায়            সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অসহায়ত্বের বিষয় সে আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করতো এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে আজীবন। তার চেষ্টা কতটা সার্থক ও ফলবতী হয়েছে, জানি না। কিন্তু তার স্বপ্ন-প্রত্যাশা ও সংকল্পের দৃঢ়তা নিশ্চয়ই রাহমানুর রাহীমের নিকট কবুল হয়েছে এবং অন্যদের জন্য তা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

আহমদ বাসির ছিল এক তরুণ-প্রতিভাবান যুবক। তার বিশ্বাস ও প্রত্যয় ছিল প্রগাঢ়। সে এক সুন্দর, শান্তিপূর্ণ, কল্যাণময় সমাজের স্বপ্ন দেখতো। তার সে স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলতে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। শুধু জ্ঞানার্জন নয়, কর্মের মাধ্যমেও সে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। এ জন্য সে প্রচুর লেখাপড়া করতো, সব বিষয়ে ছিল তার আগ্রহ। আধুনিক দৃষ্টিতে যুক্তিপূর্ণভাবে সবকিছুর সুন্দর সমাধান খুঁজে বের করার ঐকান্তিক প্রবণতা ছিল তার মধ্যে। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মনন চর্চার ক্ষেত্র ছিল তার বিশেষ আগ্রহ। এ ক্ষেত্রে সে ছিল একজন অত্যন্ত সৃষ্টিশীল মানুষ। লেখা, বক্তৃতা, সংগঠন ও সেবার মাধ্যমে সে তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছার প্রাণপণ চেষ্টায় নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এমন একজন নিঃস্বার্থ, নীরব ও আদর্শবাদী কর্মীর অকালে বিদায় গ্রহণ নিঃসন্দেহে সমাজ ও মানুষের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি এবং অপরিসীম মর্মবেদনার কারণ।        

আহমদ বাসিরের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল এবং আলোচনা হতো মূলত সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে। বয়সে সে আমার পুত্র বা ছাত্র সমতুল্য। সে আমাকে সমীহের দৃষ্টিতে দেখতো, আমিও তাকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেছি। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ ছিল তার। ষাটের দশকে আমরা প্রথম আদর্শ ভিত্তিক শিশু সংগঠন ও সাহিত্য সংগঠন করে ব্যাপক কাজ করেছি। বিদেশে অবস্থানকালেও আমি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আমার কর্মপ্রবাহ চালিয়ে গেছি। তার ইচ্ছা ছিল আমার জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে সে একটি সাক্ষাতকার  নিবে। দীর্ঘ সাক্ষাতকার। সে জন্য উপযুক্ত সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। আমাকে এ সম্পর্কে প্রস্তুতি নিতে বলেছিল। কিন্তু তার সে এরাদা পূর্ণ করার সুযোগ আর সে পায়নি। সে বিদায় নিয়েছে, কিন্তু আমার দুঃখবোধ এ জন্য যে, আমাকে নিয়ে তার যে পরিকল্পনা ছিল, সে কাজটি সে করে যেতে পারলো না। এ রকম এবং এর চেয়ে আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজই হয়তো তার অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।   

আহমদ বাসির এক বাস্তব জগতের অধিবাসী, অনেক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে সে জীবন কাটিয়েছে। তবে তার জীবনের একটা স্বপ্ন ছিল। হয়তো সে স্বপ্ন ছিল তার জীবনের চেয়েও অনেক বড়। সৃষ্টিশীল প্রতিভাবানদের সকলের জীবনেই স্বপ্ন থাকে। স্বপ্ন একান্ত ব্যক্তিগত। কিন্তু সংবেদনশীল প্রতিভাবানদের স্বপ্ন ব্যক্তিকে নয়, দেশ-জাতি ও সমাজকে নিয়ে এবং তাদের স্বপ্ন শুধু বর্তমানকে নিয়ে নয়, ভবিষ্যত নিয়েও। আহমদ বাসিরের এমনই এক মহৎ ও সার্বজনিক স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্নের চূড়া সে স্পর্শ করতে পারে নি, তা অধরাই রয়ে গেছে। তার আকাশস্পর্শী স্বপ্নের রঙিন জগতে নিঃসঙ্গ বসবাস করে সম্ভবত সে সন্তুষ্টই ছিল। সে যা করতে পারতো, তা সে সম্পন্ন করে যেতে পারেনি। সেজন্য আমরা যেমন নিদারুণ কষ্ট বোধ করছি, যদি তার আরাধ্য কাজ আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি, তাহলে তার আত্মা নিঃসন্দেহে শান্তি পাবে। 

আল্লাহ তার মাগফিরাত দান করুন, তার পরিবার-স্বজনদের প্রতি জানাই আন্তরিক গভীর সমবেদনা। আমিন।


No comments

Powered by Blogger.